Thursday, February 23, 2017

আমার ম্যাডাম

২০৭ নম্বর কক্ষ। তিন তলার এক মাথায় বড় ক্লাসরুম। প্রতিষ্ঠিত ভালো বিভাগে চান্স না পাওয়ার টিন-এইজ গ্লানি নিয়ে প্রথম দিন মাথা নিচু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসা, তা-ও আবার দেরি হয়ে গিয়েছে! ক্লাস ভর্তি না-জানি-কেমন-সব মানুষজন, অপরিচিত গন্ধ। ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে গোল ফ্রেমের চশমা পরা ছোট্ট অধ্যাপক। আমাকে দেখেই মজার হাসি দিয়ে বললেন 'ল্যাংগুয়েজ নাকি স্পেশাল? ১৫তম ব্যাচে নতুন?' আমার মাথা এমনিতেই গুলিয়ে যায়, আমি না বুঝে রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেখালাম, অধ্যাপক আবার হা হা করে হেসে ফেললেন, 'হ্যা! তুমি তো এই ক্লাসেই!'
মাঝের দিকে বসে আগড়ুম-বাগড়ুম চিন্তা, নতুন খাতা আনি নি, যেটা এনেছি সেটাতে ব্যবসায় প্রশাসনে ভর্তির এলোমেলো প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। হঠাত শুনি অধ্যাপক মজার কিছু রান্না করছেন এমন করে শাড়ির আচল কোমরে গুঁজে জিজ্ঞেস করছেন, 'তোমাদের ভেতর চলে যাবে কে কে?' অনেকেই হাত তুললো! আমি চক্ষুলজ্জার ভয়তে তুলিনি সেদিন। ম্যাডাম বললেন, 'নতুন করে ভর্তির পড়া শুরু করার আগে ক'টা দিন আমাদের সাথে ক্লাস করে দেখতেও পারো, আমরা অতও খারাপ নই!' এই বলে কী একটা মায়ায় যে বাঁধা পড়ে গেলাম! মাতৃসম বিভাগীয়-প্রধান, নতুন বন্ধুরা, নিজের কম্পাউন্ড, অনুকরণীয় অগ্রজদের আদর ছেড়ে আর যাওয়া হলোনা কোথাও।
বিশ্ববিদ্যালয় তো অনেক বড় প্রাংগন, এখানে সবাই নিজের ভাগ্য গড়ে নিতে আসে। কিন্তু আমার মত গাধাগুলার জন্য ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট লাগে। পড়ার বইয়ের রেফারেন্সের থেকে আমাদের গোত্রের বেশি দরকার হয় একটু এক্সট্রা স্নেহ-ভালোবাসা-এ্যাটেনশন-মোটিভেশনের। একটু বোঝানো দরকার পড়ে যে, 'তোমার জন্য আলাদা জায়গা তুলে রাখা আছে'। এইটুকু ছাড়া আমাদের ধরে রাখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস থেকেই ম্যাডাম আমাকে এইটুকু দিয়েছেন। খুব যে কিছু একটা করে দেখিয়ে সেটা ফেরত দিতে পেরেছি, তা বলবো না অবশ্য।
ম্যাডাম ক্লাসে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প বলতেন, আমি ব্যস্ত থাকতাম সেগুলি নিজের জীবনের সাথে মেলাতে। গল্প শেষ হলে বুঝতাম উনি আসলে একটা ইউনিট পড়ানো শেষ করে দিয়েছেন। গল্পটুকু এ্যাকাডেমিক ভাষায় উদাহরণ হিসেবে তত্ত্বের সাথে লিখলেই এ ক্লাস পরীক্ষার উত্তর তৈরী হয়!
পরের ব্যাচ ভর্তি হয়েছে। নবীন বরণ করতে হবে। ইউনিক কিছু করতে হবে। ভাষাশিক্ষার অগ্রজ সব ব্যাচ থেকে ভাইয়া আপুরা আসবেন, কিন্তু ১৬কে ১৫ই বরণ করবে, ম্যাডামের আদেশ! ১৫র থেকে মূল প্রোগ্রাম যাবে। কিন্তু কি যাবে! কোন কুক্ষণে মুখ দিয়ে লাইট এ্যান্ড সাউন্ডের কথা বের করেছিলাম, ম্যাডাম সেই নিয়েই পড়লেন। পড়লেন এবং আদায় করে ছাড়লেন। সব শেষে চেয়ার টানাটানির সময় আমাদের বললেন ৩য় শ্রেণির কর্মচারীদের সাথে হাত লাগাতে, বিভাগের প্রোগ্রামে শ্রেণিতফাত যেন চোখে না পড়ে।
তার কয়েক সেমিস্টার পরের কথা। আমরা জেনে গিয়েছি ম্যাডাম বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন- আনিসুজ্জামান স্যারদের মত মস্তান লোকদের পেয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। সেদিন আমাদের সাহিত্যের ক্লাসের প্রথম দিন। রোল কল শেষে বিরাট প্রশান্তির শ্বাস ফেলে বললেন 'সাহিত্য যে কী, এ আমি তোমাদের জিজ্ঞেসও করবো না, নিজে থেকে বলেও দিবো না, আমরা একসাথে আবিষ্কার করার চেষ্টা করবো।' সেদিন বাইশে শ্রাবণ ছিলো। ম্যাডাম সবার থেকেই একটা করে রবীন্দ্রসংগীত শুনলেন। শেষে অনুরোধে নিজে গাইলেন 'আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে'। সাহিত্য কী, বুঝতে আর বাকি থাকে?
এর পর বিভিন্ন ডামাডোলে ম্যাডাম, ম্যাডামের বিভাগ ছেড়ে চলে গিয়েছি। ব্যাখ্যা করেও যেতে পারিনি কেন গিয়েছি। চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস টের পেয়েছি, অভিমান টের পেয়েছি। নিজেকে 'স্নেহ-হারাম' মনে হয়েছে। কিন্তু অনুতাপে বিভাগের আশ-পাশ দিয়ে যাওয়াও বন্ধ ছিলো বেশ অনেক বছর। মাস্টার্সেও ফেরা হয় নি বিভাগে। এমন কয়েকটা বছর গিয়েছে বসন্ত-বৈশাখে সৌজন্য সাক্ষাত ছাড়া ম্যাডামের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় নি। মাঝে ম্যাডাম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জুনিয়রদের থেকে শুনলাম ক্লাস নিচ্ছেন না। তার পর একদিন এলেন, সিড়ি ভেঙে উঠতে পারছিলেন না। সেই দৃশ্য যে কী কষ্টের, কী ভাষায় বলি। ফোন করতে চেয়েছি কতবার, চোখে পানি এসে গিয়েছে, পরে ভেবেছি আমার ফোনে তো সুস্থ হয়ে যাবেন না, প্রার্থনাই বরং ভাল। ঈশ্বর প্রার্থনা শুনেছেন। দূর থেকে দেখেছি ম্যাডাম আবার আগের মত মজার একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। এইতো সেদিন বললেন সংগঠনের মিটিং-এর জন্য তার বাসায় হজির হতে, যতক্ষণ খুশি থাকবো। আমাদের পরিকল্পনা আছে, একদিন জাকিয়েই হাজির হয়ে যাবো! এখন দেখা হলেই কিছু একটা করে ফেলেছি কিনা এমন একটা আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কী করছো এখন?' আপনার এই আশার জোরেই একদিন দেখা যাবে সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিয়েছেন! সেদিন প্রথম আপনাকেই জানাবো।
এখন বড় হয়ে যেতে হচ্ছে, নিষ্ঠুর জগতটার মুখোমুখি হয়ে প্রতিদিনই একাধিকবার রক্তাক্ত হতে হচ্ছে, মাথা হেট হতে হচ্ছে, নিয়ত বুঝতে পারছি এই জগতে আলাদা করে কেউ বুঝতে আসবে না আমাকে, আলাদা করে তুলে রাখা ভালোবাসার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরও জানি এক জনের স্নেহ এবং আশীর্বাদ সব সময় মাথার উপর আছে, আলাদা করে তুলে রাখা। এখন বুঝি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা ধরিয়ে দিলেই এ্যাকাডেমিক কাজ শেষ হয়ে যায় না, ছাত্র-ছাত্রীগুলিকে অবুঝ পোষা প্রাণীর মত নিঃশর্ত ভালোবাসা দিয়ে আশ্রয় দিতে হয়, তখনই তারা সত্যি সত্যি বড় হবার স্বপ্ন দেখতে পারে।
এতক্ষণ যার গল্প করছিলাম, ম্যাডামের জন্মদিন আজ। কথা বলায় খুব একটা ভালো না হওয়ায় কারণে নীল বইতেই লিখলাম, এত মমতা দিয়ে সব কিছু কীভাবে ধরে রাখেন বলবেন? বছরের পর বছর কীভাবে এত সবুজ থাকছেন? পঙ্কিল পৃথিবীতে কীভাবে এত শুদ্ধ থাকা যায়, আরেকবার শেখাবেন?
শুভ জন্মদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথম অধ্যাপক, অনুপ্রেরণাদাত্রী, মমতাময়ী, চিরসবুজ শ্যামলী আকবর ম্যাডাম।

Wednesday, January 4, 2017

জায়ান্ট মেগাথ্রাস্ট

ডিসক্লেইমারঃ আমি জিওলজিস্ট নই। আমার পড়াশোনার বিষয় ভূতত্ত্ব নয়। তাই আমার কথায় যথেষ্ট ভুল, সংশয় এবং অপূর্ণতা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, সেগুলি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার এবং শুধরে দেবার অনুরোধ রইলো। ভয় পাওয়ার কারণে আমি ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলো বুঝার ক্ষুদ্র নগণ্য চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে সর্বসাধারণের কনসার্নড হবার সময় এসেছে।

সাধ্যমত তথ্য শেয়ার করা এবং আতংক ছড়ানোর ভিতর পার্থক্য আছে। আমরা আসলে এমন একটা অবস্থানে আছি যা-তে আতংক যে পর্যায়েরই ছড়ানো হবে, মূল ঘটনার ভয়াবহতা তার থেকেও শত-সহস্রগুণে বেশি হবে।

জাফর ইকবাল স্যার বলেছিলেন, কোন বিষয়ে ভয় থাকলে তা নিয়ে পড়াশোনা করলে ভয় কেটে যায়। ভূমিকম্প এবং আমাদের দক্ষিণ এশীয় টেকটনিক প্লেট নিয়ে পড়াশোনা করে আমার ভয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। এখন আমি যতটুকু বুঝেছি সেটুক বলতে গেলে দু'টো সমস্যাঃ ক) এই বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার অভিজ্ঞতা নেই আমার, সুতরাং এর গ্রহণযোগ্যতা প্রায় নেই বললেই চলে; খ) একজন ভূতাত্বিক যত সুন্দর এবং সহজ করে পুরো বিষয়টা প্রকাশ করতে পারবেন, আমি ঠিক তেমন পারবো না, বরং গুলিয়ে ফেলবো।

মূল কথায় আসি। দক্ষিন এশীয় প্লেটটা ঠিক মূল ইউরেশিয়ান প্লেটের অংশ নয়, একটা নৌকার মত ভেসে এসে ইউরেশিয়ার মূল ভূখন্ডে ঠেকেছে (ভেসে আসার ছবি এ্যাটাচড আছে)। এখন নৌকো ডাঙ্গায় ভিড়লে পাড়ের মাটি একটু উঠে আসে যেমন, খানিকটা সেই প্রক্রিয়াতে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি (স্যাটেলাইট ম্যাপের ছবিটাতে লাল চিহ্নিত অংশটুকু)। তো, টেকটনিক প্লেট গুলির তলায় প্রতিনিয়ত লাভা প্রবাহিত হবার কারণে সব গুলি প্লেটই একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সে হিসেবে দক্ষিণ এশীয় প্লেটটা আরেকটু উত্তরে উঠে ইউরেশিয় প্লেটের গায়ে চেপে বসার চেষ্টা করছে।

দক্ষিণ এশিয় প্লেট যেভাবে তরী ভিড়ালো।


মূল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলি লাল দাগের ভেতর।

















একটা প্লেট আরেকটা প্লেটের গায়ে চেপে বসলে তাদের মাঝে যে গ্যাপটা আছে, সেখানে অবস্থানরত ভূগর্ভস্থ গ্যাসগুলো বের হয়ে আসে। আবার ঘুরিয়ে চিন্তা করলে ভূগর্ভস্থ গ্যাস এর চাপ বের হয়ে আসলে ওই শূণ্যস্থান পূরণের জন্য ভূমি সরে যায়। তখন আমরা ভূমিকম্প অনুভব করি।

তো আমাদের কনটেক্সটে লাল চিহ্নিত অংশুটুকুতেই বেশিরভাগ বড় বড় ভুমিকম্পগুলো হয়েছে। এগুলো দৈব নয়, ঐগুলিতেই হওয়ার কথা। এবং সেগুলির একটা প্যাটার্নও খুজে পাওয়া সম্ভব। আফগানিস্তানের বর্ডার, নেপাল, মিয়ানমার ইত্যাদি জায়গার ভূমি নিজের মত সরে সরে গিয়েছে। একটা জায়গায় গ্যাপ থেকে গেছে সেটা হলো সিলেটের খুব কাছে ডাউকি ফাটলে। এই ফাটলকে ইন্টারসেক্ট করেছে শিলং প্লেটো, এই কারণে ডাউইকির একটু বিশেষ তাৎপর্য আছে। সেখানে শখানেক বছর আগে শেষ ভূগর্ভস্থ চাপ অবমুক্ত হয় (যার কারণে ১৮৯৭-এ ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথই পালটে যায়)। এর পর অন্য ফাটল বা গ্যাপ গুলি থেকে চাপ নির্গমন ('১৫র নেপাল, গেল বছর মিয়ানমার) হয়ে গেছে, কিন্তু ডাউকি থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া যায় নি। এ্যামেরিকান জিওলজিস্টরা বলছেন, ডাউইকি ফাটল জীবন্ত হয়ে ওঠার সময় পার হয়েছে অনেক আগেই। যত দেরি হবে তার তীব্রতা (পড়ুন ভয়াবহতা)-ও তত বেশি হবে। এখন, কবে হবে সেটা বোঝার একটা উপায় হলো বড় ভূমিকম্পের আগে দিয়ে মূল ফাটলের আশে পাশের শাখা ফাটলে ছোট ছোট কম্পন হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে গতকাল (৩ জানুয়ারি ২০১৭)-এর কম্পন দুটোই ডাউকির কাছে ত্রিপুরা এবং আরাকান হতে উৎপন্ন। সুতরাং দু'শো বছরের অপেক্ষার পালা প্রায় শেষ যে কোন মুহূর্তে (এই লেখার শেষে একটা নিউজ লিঙ্ক আছে)। উল্লেখ্য, ২০১৫তে নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের আগে খুব ছোট মাত্রার বেশ কয়েকটা কম্পন ধরা পড়েছিলো। [ডাউকি ফল্টের জিওলজিক্যাল ইতিহাস এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে কয়েকটা ভালো এবং বড় গবেষণা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই করেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ সেগুলির কথা জানতে পারছে না।]






ডাউকি এবং শিলং ফল্টের অবস্থান।


বড় ভূমিকম্প বকেয়া আছে, হলে কী কী হবে, কত জন আনুমানিক মারা যাবে, ক্ষয় ক্ষতি কেমন হবে, এইসব ইতিহাস আমাদের প্রায় মুখস্ত। কেউ এগুলি নিয়ে প্যাচাতে আসলে বিরক্ত লাগে। কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। হেসে উড়াবো না তো মুখ গোমড়া করে বসে থাকবো? না। যা ক্ষতি হবে সেগুলো ঠেকানোর উপায় মানবসন্তানের জানা নেই, সেই ক্ষমতাও নেই। কিন্তু মানুষ সতর্ক থাকতে পারে। নলেজ শেয়ার করতে পারে। প্রি-কশন নিতে পারে।

ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান এ্যান্ড্রিয়াস ফল্টে একটা বিভৎস ভূমিকম্প অনেক বছর ধরে বকেয়া। তারা কিন্তু জিনিসটাকে গা সওয়া বানিয়ে ফেলেননি। প্রত্যেক মাসে জিওলজিস্টরা সার্ভে করছেন, ইঙ্গিত গুলো বুঝার চেষ্টা করছেন, জাতীয় পর্যায়ে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাচানোর জন্য, সেই নিয়ে গবেষণা করছেন। আমার আক্ষেপ হলো, এই বকেয়া ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নাই। আমাদের এখানে যা গবেষণা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ সেগুলি না জানলে মানসিক প্রস্তুতি নেবে কীভাবে? "যখন মৃত্যু আসবে তখন দাঁত কেলিয়ে মরে যাবো" তো কোন কাজের কথা না? মানুষের জীবনের দাম এতই কম?

আতংক নয়, ফ্যাক্ট, ডাউকি এ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেল কয়েকবারের মত 'মৃদু ঝাঁকুনি অনুভূত' হবে না, আমাদের সভ্যতাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার আগেই মানুষের প্রাণ বাচানোর কোন একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। ঢাকার উপর অবিলম্বে জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসনিক পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেকটা সচেতন নাগরিকের জানতে হবে এই ভূমিকম্প কীভাবে হতে যাচ্ছে, কীভাবে এর থেকে বাচা যায়, কীভাবে আরেকটু সতর্ক থাকা যায়। দুশ্চিন্তায় জীবন থামিয়ে দেবার কথা বলছি না, বলছি খাওয়া-ঘুমের মতই সতর্কতাটুকু গ্রহণ করার কথা।

সকলের জন্য সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের কামনা করছি।


নিউজ লিঙ্কঃ http://www.dailymail.co.uk/…/Giant-megathrust-fault-discove…

গবেষণা লিঙ্কঃ
১। http://www.sciencedirect.com/…/article/pii/S1367912011002021
২। http://www.sciencedirect.com/…/article/pii/S1367912014002454

বিঃদ্রঃ https://www.usgs.gov এ ভিজিট করে পৃথবীতে ঘটা বর্তমান এবং বিগত সব ক'টা ভূমিকম্পের ভিজ্যুয়াল পাওয়া সম্ভব। বেকার বসে থাকলেই আমি মুখ আমশি করে এই সাইট খুলে দেখতে থাকি।

Tuesday, December 20, 2016

বিউটি বোর্ডিং

১ নং শ্রীশ দাস লেন। সন্ধ্যে বেলা জ্বালানো হয়েছে হলুদ বাতি, আলো আঁধারীর খেলা। ভেবে দেখুন আপনার পাশে বসেই চায়ের কাপে আড্ডা জমিয়েছেন শামসুর রাহমান, আহমেদ ছফা, জহির রায়হান, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ এবং শহীদ কাদরীরা। জায়গাটা পঞ্চাশের দশকে ছিলো দৈনিক সোনার বাংলা পত্রিকার অপিস। নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের বাসভবন। দেশভাগের সময় পত্রিকা চলে গেল ওপার বাংলায়, আর জমিদারের থেকে পাইক-পেয়াদাদের ব্যবহৃত ভবনের একটা অংশ দু'ভাই, প্রহাদ চন্দ্র সাহা আর নলিনী মোহন সাহা, খুললেন বিউটি বোর্ডিং।

দো'তলা ইংরেজি টি আকৃতি'র বাড়ি, নিচ তলায় এক অংশে খাবার ঘর, বাকি ঘর গুলিতে বসবাসের ব্যবস্থা। হলুদ রঙ করা বুড়ো দেয়াল, গাছপালার ছায়াঘেরা ছিমছাম কম্পাউন্ড। একটা দপ্তর কামরা আছে, ভেতরে কাঠ-খোদাই পুরোনো আসবাব। তাতে হিসেব-নিকেশে মশগুল তারক সাহা। তিনি বললেন, যুদ্ধের সময় বাবা প্রহাদ সাহাকে মেরে ফেলে এই বোর্ডিং-এই। জ্যাঠা, মা, সমর আর তারক দু'ভাই ভারতে পালিয়ে বাঁচেন। '৭২-এ আবার তাঁরা ফিরে এসে চালু করেন বোর্ডিং। সেই থেকে চলছে আড্ডা, সাথে ভোজন।

কফি হাউজ নিয়ে মান্না দে গান গেয়ে গেছেন ঠিকই, বিউটি বোর্ডিং-এর কথা কেউ মনে রাখে নি। প্রথম বাংলা ছবি 'মুখ ও মুখোশ'-এর পান্ডুলিপি রচিত হয়েছে বিউটি বোর্ডিং-এর আঙ্গিনায় বসে, পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের হাতে। সব্যসাচী সৈয়দ হক তাঁর 'অনুপম দিন', 'সীমানা ছাড়িয়ে'র মত উপন্যাস লিখে গিয়েছেন এখানে বসে। পাঁচ-পাঁচটে বছর এই বোর্ডিং ছিল কবি নির্মলেন্দু গুণের গৃহ। জুয়েল আইচ ঢাকায় এসে প্রথম আস্তানা গেড়েছিলেন এই বোর্ডিং-এ। তবে এই সংষ্কৃতি চালু প্রথম হয় শহীদ কাদরীর হাত ধরে। এখানে অবস্থানকালে কবি তাঁর এক বন্ধুকে চা-আড্ডার দাওয়াত দিয়েছিলেন।

এখন আর আড্ডা চলে না? কবি সাহিত্যিকরা আসেন না? না। এখন বিউটির সেই জৌলুস নেই। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বোদ্ধারাএখন বসেন বেঙ্গলে, ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে, বা দৃকে অথবা অন্য কোথাও। কিন্তু ফি বছর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার একটা ক্লাস হয় বিউটি বোর্ডিং-এ। এছাড়া দিনে ভিড় জমে থাকে বাংলাবাজারের প্রকাশনাকর্মীদের ভোজনবিলাসে। আগের মত জমজমাট রাত্রিযাপন নেই। তারপরও মাথাপিছু ছ'সাতশ' টাকায় একটা দল বুকিং দিয়েছে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করবে, সাথে থাকব কাবাব পোড়ানো। তবে দলে নারী সদস্য থাকলে বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা পালন করা হয় বিউটিতে।

তারক সাহা বললেন শিল্প-সাহিত্য-সংষ্কৃতির চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে বেশ, পুঁজির বাজারে মনের খোরাক পুরোনোর চাহিদা উবে যাওয়ার সাথে সাথে উবে যাচ্ছে উৎকৃষ্ট আড্ডার সংষ্কৃতি। বাংলাবাজারের রাস্তা ধরে ১ নং শ্রীশ দাস লেনে যাবার সময় চোখে পড়বে মওলা ব্রাদার্স, আজাদ প্রোডাক্টস, এমদাদিয়া বুক হাউজ, বেঙ্গল স্টেশনারি সহ বহু পুরাতন এবং ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের নাম। কাছেই সুবাস বিলোচ্ছে সুপ্রাচীন ক্যাফে কর্নারের মাটন ক্রাম্ব চপ। ঘিঞ্জি রাস্তায় শীতের সন্ধ্যের আলো ডোবার সাথে আপনি টের পাবেন মৃদু আর্দ্র বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে, অদূরেই বয়ে যাচ্ছে ঢাকার কালের সাক্ষী বুড়িগঙ্গা। তার স্রোত বহন করছে শতাধিক বছরের পুরোনো এক নগরীর গল্প। সে কথা আরেক দিন হবে।



Tuesday, December 6, 2016

একটা সাবঅলটার্ন গল্প

মাঝে মাঝে দ্রোহ ভর করে। দু'পাঁচ মিনিট আস্ফালন করে। তার পর লেজ গুটিয়ে গর্তে পালায়। হাঁটুভাঙ্গা মেরুদন্ডবিহীন ব্যক্তিত্বহীনতা সদর্পে মঞ্চে ফিরে আসে। তার সে যে কি দোর্দন্ড প্রতাপ! তবে স্ট্রিং থিওরি বলে যে সব ডেটা এনক্রিপ্টেড থাকে। খুব অল্প কিছু সময় মনে হয় ঝড়-টড় আসলেই একদিন থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে, বিকেলে আমরা ব্যালকনি বা উঠোনে বসে মেলামাইনের কাপে লাল চা আর মুড়ি খাবো। বিড়ালটা ঝিমোবে। অথবা যে চিলটা দিনমান আকাশে গোল করে চক্কর খায়, কালারব্লাইন্ড আমি তার রঙ বুঝতে পারবো না। তার পর সন্ধ্যে হলে গাছের ফাঁক দিয়ে ল্যাম্প পোস্টের মৃদু হলদেটে আলো আসবে, কিন্তু সামনের বাড়ির মাস্টারনী প্রাইভেট পড়িয়ে বাসায় ফিরে রিক্সাভাড়া দিতে পারবে না। অথবা আমরা নক্ষত্রের রাত দেখবো না, আগেই ঘুমিয়ে পড়বো, অসম্ভব মায়াময় একটা ভোরের স্বপ্ন নিয়ে যাতে কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে সরু একটা রশ্মি মার্কিন কাপড়ের বিছানার চাদরে খেলা করে। কিন্তু কোন একটা কারণে সাড়ে ছয়টার এ্যালার্মটা কেন যেন বন্ধই করা যাবে না। নস্ট্রাডামাস এর ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হয় নি যে। তবে একটা তারা খসে গিয়েছিলো, সে কথা দো'তলা-নিচতলার সবাই মনে রেখেছিলো। আর মনে রেখেছিলো কমলা রঙের হকি-স্টিক দিয়ে ক্রিকেট খেলা। মনে রাখেনি হারিয়ে যাওয়া ব্যাঙের ছানাটার কথা। অথবা মুকুলের কথা। অথবা পরম নির্ভরতার গৃহের গন্ধটার কথা।

শান্তি বর্ষিত হোক, মঙ্গল বিরাজ করুক।

Monday, October 31, 2016

ননসেন্স ডিমপোচ



রুটিনমাফিক চলার বিষয়টা জেলবন্দীর মত অনুভূতি দেয়। শরীর, মন, কাজ ঠিক রাখার জন্য প্রত্যেকদিন আমাকে একই নিয়মে চলতে হবে, এটা শাস্তি ছাড়া আর কী? নিয়ম করে খাওয়া ঘুমুনোর বাধ্যবাধকতা যখন থেকে আরোপিত (ঘাড় ধরে ট্র্যাকে তোলার চেষ্টা) তখন থেকেই নিজেকে একটু অন্য ভাবে ট্রেইন করে তোলার ইচ্ছে ছিলো। আই উইল বি দ্য মাস্টার অফ মাইসেলফ টাইপের একটা গোয়ার্তুমি ধরে বসেছিলো। নিয়ন্ত্রণটা অনেকটুকু নিয়েও ফেলেছিলাম। যখন খুশী, যতক্ষণ খুশী জাগবো, বদলে কম্পেনসেশন/ভর্তুকি/ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক্সট্রা যতটুকু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন, খেয়ে নিবো। নিজেকে এই ট্রেইনিংটা দিতে গিয়ে একটা অদ্ভূত ক্রাইসিসের ভেতর পড়ে গেলাম। যেখানে আসলে কনসেন্ট্রেশন রয়েছের থেকেও যেখানে কনসেন্ট্রেশন দেওয়া লজিক্যালি প্রয়োজন সেখানটাতে মনযোগ দেওয়া শুরু করলাম। যেই কাজে আসল আগ্রহ নেই, সেখানেও মনযোগ দিয়ে কৃত্তিম আগ্রহ সৃষ্টি করে এ গ্রেডের কাজ বের করে আনতে শুরু করলাম। এর পেছনে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষা ব্যবস্থার যে কোন ভূমিকা ছিলো না তা নয়। টেন্ডেন্সি যাই হোক না কেন, টেক্সট বুক যাই হোক না কেন, সিস্টেম যাই হোক না কেন, রেজাল্টটা ঠিক থাকা চাই, হোক তাতে যে কোন ক্ষতি। ক্ষতির বদলে যা পাওয়া তাতে যাবে পুষিয়ে। এই করে যেটা হলো, মোজার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভেতরের দিকটা বাইরে বের করে নিয়ে আসলে যেমন হয়, আমার নিজের অবস্থা দাঁড়ালো তাই। ইনসাইড আউট। যেটা সম্পূর্ণই সামঞ্জস্যহীন! 

‘সামঞ্জস্যহীন’ বিষয়টা আরেকটু ভেঙ্গে বলা দরকার। মানে আমি আসলে যে মানুষটা, আমার যা বৈশিষ্ট্য, মানসিকতা, চিন্তা ভাবনা, দর্শন, ইত্যাদি পাল্টে অন্য কিছু একটাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়ার ভেতর ঢুকে পড়া হলো। এর ফলে আমি হয়ে গেলাম না ইধার-কা, না উধার-কা। আমি আমি-ও থাকলাম না, আমি অন্য কেউ-ও হয়ে গেলাম না! মাঝামাঝি একটা দোটানায় পড়ে যাওয়া ছাব্বিশোর্ধ তরুণ। এর ফলে আমার ভেতর দেখা দিলো মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। একেক সময় আমি একেক মানুষ, একেক পরিস্থিতিতে আমার বৈশিষ্ট্য একেক রকম। বহুরূপী আর কি। পুরো ব্যাপারটা যত আর্টিস্টিক, বর্ণিল আর আনন্দদায়ক শোনাচ্ছে, ভিক্টিমের জন্যে আসলে এটা ততটাই কষ্টদায়ক। নাটকীয় ভাষায় বললে অভিশাপস্বরূপ আর কি। অভিশাপের কারণটা হলো, আমি নিজে আসলে কে সেটা হারিয়ে গেছে। আমি আসলে কী সেটা বিস্মৃত। 

ধরেন, মানুষ ইন্ট্রোভার্ট হতে পারে, বা এক্সট্রোভার্ট হতে পারে। আমার চিন্তা ভাবনা জড়তা সব একজন ইন্ট্রোভার্টের মতন, কিন্তু সামাজিক পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে ভয়াবহ একটা মানসিক কষ্টের ভিতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে আমূল ট্রান্সফর্ম করে কাজ চালানোর মত এক্সট্রোভার্ট হয়ে যাই! এই প্রক্রিয়া সারা দিনে এতবার চালাতে হয়, হয়েছে, যে আমি ভুলে গিয়েছি আমি আসলে কে! আবার মনে করেন আমি পছন্দ করছি একজন হিপ্পি ধরণের মানুষের সাথে ওঠা বসা, কিন্তু আমার ভিতরের প্রায় অর্ধাংশ (বা তার একটু বেশি) অংশ সারাক্ষণ চাপ দিয়ে যাচ্ছে নিয়মমাফিক চলাফেরা করা প্রগ্রসিভ ভালো ছাত্র গোছের কারো একজনের সাথে মেশার জন্য। আবার কোন কোন সময় আরও অদ্ভূত সমস্যার উদ্ভব হয়। বাউন্সিং। ধরেন আমার এখন একটা লেখা শেষ করতে হবে, যেটা আমার মোটেই ইচ্ছে করছে না, আমার মাথায় ঘুরছে কোন একটা টিউন যেটা না তুললে আমারে পীড়া দিতেই থাকবে। গিটার নিয়ে যখন গুছিয়ে বসবো তখন আবার অন্য অংশ ডোমিন্যান্ট হয়ে গিয়ে চাপ দেওয়া শুরু করবে ‘এগুলো কী করছো? তোমার তো লেখার কথা এখন! লেখা শুরু করো, ফেলো এগুলো!’ নিজের উপর বিতশ্রদ্ধ হয়ে সব ফেলে লিখতে বসলে কী লেখা আর বেরোয়? নিজের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমি তখন কোন টিউন-লেখা দুই-ই ফেলে ঘুমুতে চলে যাই। ঘুমের ভেতর মাথায় বাজতে থাকে টিউন! কিন্তু টিউন তুলে জীবিকা নির্বাহের জন্য যেই সাধনা করার দরকার ছিলো, তা-ও নেই, জীবিকার যেই রাস্তা আরোপিত সেই পথও বহু দূর! 

তো এই দোটানা/ত্রিটানা/বহুটানা’র ভিতর পড়ে আমার এখন একক কিছু হওয়ার সাধ এবং সাধ্য দুই-ই চলে গিয়েছে। কোন একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে পড়ে যাওয়াটা বীভৎস মনে হয়। কোন কিছু একটা করতেই হবে এমন মনে হলেই সেই কাজ থেকে মন উঠে যায়। এই মাত্র মনে হলো এই লেখাটা ঠিক ভাবে শেষ করাটা আমার কাজ। যে মনে হওয়া, সেই মাত্রই আর লিখতে ইচ্ছে করলো না, ইতি টানলাম। এই সমস্যা, নিজের সাথে যুদ্ধ করার বিষয়টা হয়তো সবারই আছে, কিন্তু সবাই যেটা করা দরকার সেখানে ফোকাস করতে পারেন, আমার সেই অক্ষমতাটুকু আছে। কিন্তু সে যে কী যন্ত্রণা, তা আমার দুর্বল ভাষাদক্ষতা দিয়ে বোঝানো সম্ভব না। কেমন হলে ভালো হতো, সেইটে ভুলে গিয়েছি।

পুরা সমস্যাটা আমি যেমন খানিকটা মানসিক রোগের ফ্লেবার দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করলাম, আসলে তেমনটা না-ও হতে পারে। হতে পারে আমি আসলে একটা ননসেন্স ফাতরা, যাকে দিয়ে আসলে কিছুই সম্ভব নয়! হা হা!

Image result for broken egg
চিত্রঃ ভেঙ্গে যাওয়া সম্ভাবনাময় একটি ডিম কে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত সুস্থ দু'জন ডিম
[কৃতজ্ঞতাঃ এইজলিং ও'কনর এর ফ্লিকার]

Sunday, June 12, 2016

দালি'র হাতিরা এবং সেদিনকের ঘটনাটা...

হয়েছে কি, কী একটা যেন পড়তে গিয়েছিলাম। পড়া শেষ করে বেরিয়ে অপূর্ব ফোন দিলো। জরুরী তলব। বাসায় না গিয়েই ওর বাসার আশেপাশে দেখা করলাম। ও গলা নামিয়ে বললো 'এই এই' হলো ঘটনা। আমিও আর কাল বিলম্ব না করে রাস্তায় সবার সামনেই (এবং সবার অলক্ষ্যে) চোখের নিমেষে খাকি ইউনিফর্ম বুট-টুট পরে নিলাম, অপূর্ব-ও। আমাদের দু"জনেরই পুরনো কিন্তু অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রীয় (থ্রি-নট-থ্রি'র মত দেখতে) হাতিয়ার। কাঁধে বই খাতার ভারী ব্যাগ এবং ইউনিফর্ম-বুট-হাতিয়ার নিয়ে আমরা দু'জন দু'দিকে ছড়িয়ে গেলাম। এর মধ্যে অবশ্য আরেকবার দেখা হয়েছিলো, কাকে যেন তাড়া করতে গিয়ে আমরা একটা গলিতে ঢুকে গেলাম, তারপর একটা অন্ধকার বাড়ির খিড়কি দিয়ে উঠে কাকে যেন অস্ত্র-শস্ত্র দেখিয়ে আর চিৎকার করে ভয় দেখিয়ে আসলাম।

বেশিক্ষণ সময় লাগলো না, রুবিক'স কিউবটা আমিই খুজে পেলাম। হঠাত দেখি রিক্সা চেপে অপূর্ব আসছে, রিক্সার ধাক্কায় পড়ে গেলাম। গিয়েই আমার (জীবনে প্রথমবারের মত) আমার অস্ত্রটা লোড করে ওর দিকে তাক করে ঘোড়া টিপে দিলাম, অনেক বার। গুলিগুলো ওর মুখের মধ্যে ঢুকে গেলো আর ও তেমন ভীতি কর কিছু করতে পারলো না। ওকে ফেলে হাউজিং-এর দিকে রওনা হলাম। হওয়ার পথে মনে হলো হায় হায় ওর কাছে তো অস্ত্র বা ইউনিফর্ম কিছুই ছিলো না, মারলাম কেন? যেই মনে হওয়া অমনি ফোন দিলাম, 'দোস্ত কই তুই, গেটের সামনে আয়।' চলে এলো। ওর বাসায় উঠলাম, উঠে অপরাধবোধে আমি তেমন কিছু বলছি না, ও-ও নরমাল। হঠাত দেখি আমাদের দুর্ধর্ষ ঘটনাটা নিউজ হয়ে গিয়েছে অনলাইনে। আমরা একই সাথে চিন্তিত এবং আনন্দিত হয়ে পড়লাম। হঠাত কি হলো আমি ওকে জড়ায়ে ধরে 'ভাই আমার, তোকে আমি কিভাবে শ্যুট করতে পারলাম, বেশি ব্যথা পাসনি তো?' বলে কেঁদে ফেললাম।

এই করতে করতে দেখি রাত হয়ে গেছে। এক রাশ সাফল্য, চাপা আনন্দ, ভীতি নিয়ে আমরা রাস্তায় নামলাম। ওকে বললাম, নিউজগুলা দেখতে তো মজাই লাগছে, থেকে যাবো নাকি তোর বাসায় রাতে? ও বললো আমাকে রিক্সে করে বাড়ি দিয়ে আসবে। রিক্সা খোঁজার জন্য নির্জন রাস্তায় হাঁটছি, হঠাত একটা রিক্সা-ও এলো, সাথে দু'পাশ দিয়ে দু'জন লোকও এলো। অপূর্ব বললো ও উঠছে, কিন্তু আমার ডান পাশে উঠে বসলো চেক শার্ট পরা গাট্টা-গোট্টা লোকটা, খানিকটা ভয়ই পেলাম। তারপর একটা মোড় আসতেই বললাম 'আপনি যাবেন কই?' লোকটা বললো 'ক্রিসেন্ট লেক'। এই মাঝরাত্তিরে ক্রিসেন্ট লেক (যদিও আমার বাসার কাছেই)! একটা মোড় আসতেই বললাম 'আচ্ছা তবে, আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি, এখানেই নামবো, আপনি চলে যান, স্লামালিকুম।' মানিব্যাগ বের করে দেখি অসংখ্য পাঁচ টাকার নোট, গুণে দিতে সময় লাগলো।

এখন কী করি? কোথায় নামলাম চিনতেও পারছি না। রিক্সেও পাচ্ছি না। খালি বসে আছে, কিন্তু আমি জানি যাবে না, কই যেন লেখা আছে। দাঁড়িয়ে আছি, অনেক রাত হয়েছে, কিন্তু একটু একটু সূর্য উঠছে। এক লোক একটা চপার টাইপের মোটরসাইকেল চালিয়ে এসে আমার সামনেই রাখলো, রেখে কই যেন হাওয়া হয়ে গেলো। অগত্যা আর কি করা, পকেট থেকে চাবি বের করে, ভারী ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে (জীবনে প্রথমবার) বাইক চালিয়ে বাসায় চলে এলাম। শুধু চলেই যে এলাম তা নয়, লিফটে একেবারে ৬ তলার সিঁড়িঘরে তুলে ফেললাম, এখন মনে হলো, ফেরত দিবো কীভাবে? তারপর সিড়িঘরে (যদিও বাতি জ্বলছিলো না) সুইচ নিবিয়ে বাসায় ঢুকলাম, পিপ-হোল দিয়ে দেখি বাইকের উপর কে যেন একটা হলদেটে তোয়ালে মেলে রেখে গেছে। বাঙ্গালী!

ঘরে এসে ঘুমুবো, হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেলো।

Thursday, March 5, 2015

মহাকালের দীর্ঘশ্বাস অথবা তারা ভরা রাতের কথা



বসন্তের সন্ধ্যেবালা। মাতাল হাওয়া। নির্জন রাস্তায়, শূন্য পকেটে হেঁটে আসার সময় হঠাৎ খেয়াল করবেন কমলা ফ্লুয়োরোসেন্ট আলোয় আপনার ছায়া আপনার সাথে হাঁটছে। নিজের সাথে নিজেই হাঁটা কি চমৎকার একটা বিষয়, ভাবা যায়? কি বিষ্ময়কর! তবে বড়দের বললে তেতে উঠে – “বড় হবি না কখনও?”

জীবনটাকে উল্টে-পাল্টে দেখতে গিয়ে এলোমেলো করে ফেলেছি। কিন্তু আস্তে আস্তে আবার ঠিক-ও হয়ে যাচ্ছি। অদ্ভুত এক হীলিং ক্ষমতা মানুষের। একটা শিশুবৎ বিষয় আছে। ভ্যান গগের সব কয়টা ছবি নিশ্চই এক বারে হয়ে যায় নি, রবীন্দ্রনাথ-ও নিশ্চই এক টানে সব লেখা লিখে ফেলেননি, হকিং সাহেব-ও নিজের থিওরি নিজেই ভুল প্রমাণ করে দাঁত বের করে হেসে ফেলেছেন।

কত সহস্র বছর ধরে তিলে তিলে আমরা সভ্যতা তৈরী করলাম, আবার নিজেরাই ধ্বংস করে ফেললাম, তার পর আবার তৈরী করলাম। কি অদ্ভূত এক মায়ার খেলা খেলে চলেছি! রাজা খুফুর পিরামিডের সব চেয়ে উপরের প্রস্তর-খন্ডটার জ্যামিতি বের না করতে পেরে আমাদেরই কেউ কত রাত চুল ছিঁড়েছে, নাম ভুলে যাওয়া কোন গ্রীক পূর্বপুরুষের কত রাত কেটে গেছে টিমটিমে রাতের তারা গুলির দিকে তাকিয়ে থেকে। আমারই কোন এক প্রপ্রপ্রপিতামহ মশালে আলো জ্বেলে বাইসনের জীবন্ত ছবি একেছিলেন আলতামিরায়, আবার কোন এক গন্ডগাঁয়ে গান বেধেছেন লালন ফকির। রাজস্থানে কেল্লার পাশে তারার আলোয় একতারের বাদ্য যন্ত্রে নিপুন ঘর্ষণ করুণ সুর তুলেছেন পাগড়ি মাথায় চেহারা ঢাকা রহস্যময় পুরুষ। মোঘল অন্দরমহলে ঘটে গেছে কত রাজনীতি, আবার মিসিসিপির কিনার ঘেঁষে ক্যানু বাওয়া রেড ইন্ডীয়ান এক দৃষ্টিতে দেখে গিয়েছে রাশে রাশে ঝরে পড়া ম্যাপল পাতা মাতাল হাওয়ার ঘূর্ণিতে অজানার দেশে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সেই হাওয়ার সাথে এই বসন্তের সন্ধ্যেবেলা বয়ে যাওয়া হাওয়ার কোন পার্থক্য আছে কি? পার্থক্য আছে ক্যানু বাওয়া রেড ইন্ডিয়ান যুবা আর সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা বেকার যুবকের মনের মাঝে? যার সাথে কখনই দেখা হয় নি, সেই রাজস্থানী পুরুষের করুণ সুর হাজার মাইল দূরে বসা তরুণের মনে মধ্য রাত্রিতে কেন হানা দেয়? কিছুদিন গেলেই এ-দেওয়াল ও-দেওয়াল কেন রঙে ভরিয়ে দিতে মন চায়, সে কি আলতামিরার আঁকিয়ে পূর্বপুরুষদের প্রভাব? কত রহস্য ভেদ হয়ে গেছে, তার পরও তারা ভরা রাতে ছাদে শুয়ে আর ঘরে ফিরতে সায় পাওয়া যায় না?

পৃথিবী আর জীবনটা আমরা একটু জটিলই করে ফেলেছি। এত জটিল আসলে হয়তো নয়। অথবা জীবনের হয়তো নিজস্ব স্বত্বা আছে, চরিত্র আছে। প্রিয়জন আর আর চোর এর সামনে আমাদের যেমন ভিন্ন চেহারা ফুটে ওঠে, জীবনও নিশ্চই আমাদের সাথেও ব্যক্তিভেদে তা-ই করে।

অপার বিষ্ময়কর এক বিশালত্বে ভরা সবকিছু। আনন্দ-বেদনা-বিষন্নতা-ক্ষোভ-মোহ-প্রীতি সব অনুভূতি, সব কিছুই কি বিষ্ময়কর! আমি বলি, “কক্ষনও বড় হব না। ক্যালভিন এ্যান্ড হবস পড়ে, তারা গুণে, ছবি এঁকে, ছায়া দেখে জীবন কাটিয়ে দিবো। এত মধুর জীবন জটিল করে মরে যাবো না।” 

"...ওগো ফাগুন ছেলে, নতুন পাতার দিনে, ফিরে এসো এই গাঁয়ে দুঃখী দিন ফেলে..." - মহীনের ঘোড়াগুলি