Thursday, February 23, 2017

আমার ম্যাডাম

২০৭ নম্বর কক্ষ। তিন তলার এক মাথায় বড় ক্লাসরুম। প্রতিষ্ঠিত ভালো বিভাগে চান্স না পাওয়ার টিন-এইজ গ্লানি নিয়ে প্রথম দিন মাথা নিচু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসা, তা-ও আবার দেরি হয়ে গিয়েছে! ক্লাস ভর্তি না-জানি-কেমন-সব মানুষজন, অপরিচিত গন্ধ। ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে গোল ফ্রেমের চশমা পরা ছোট্ট অধ্যাপক। আমাকে দেখেই মজার হাসি দিয়ে বললেন 'ল্যাংগুয়েজ নাকি স্পেশাল? ১৫তম ব্যাচে নতুন?' আমার মাথা এমনিতেই গুলিয়ে যায়, আমি না বুঝে রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেখালাম, অধ্যাপক আবার হা হা করে হেসে ফেললেন, 'হ্যা! তুমি তো এই ক্লাসেই!'
মাঝের দিকে বসে আগড়ুম-বাগড়ুম চিন্তা, নতুন খাতা আনি নি, যেটা এনেছি সেটাতে ব্যবসায় প্রশাসনে ভর্তির এলোমেলো প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। হঠাত শুনি অধ্যাপক মজার কিছু রান্না করছেন এমন করে শাড়ির আচল কোমরে গুঁজে জিজ্ঞেস করছেন, 'তোমাদের ভেতর চলে যাবে কে কে?' অনেকেই হাত তুললো! আমি চক্ষুলজ্জার ভয়তে তুলিনি সেদিন। ম্যাডাম বললেন, 'নতুন করে ভর্তির পড়া শুরু করার আগে ক'টা দিন আমাদের সাথে ক্লাস করে দেখতেও পারো, আমরা অতও খারাপ নই!' এই বলে কী একটা মায়ায় যে বাঁধা পড়ে গেলাম! মাতৃসম বিভাগীয়-প্রধান, নতুন বন্ধুরা, নিজের কম্পাউন্ড, অনুকরণীয় অগ্রজদের আদর ছেড়ে আর যাওয়া হলোনা কোথাও।
বিশ্ববিদ্যালয় তো অনেক বড় প্রাংগন, এখানে সবাই নিজের ভাগ্য গড়ে নিতে আসে। কিন্তু আমার মত গাধাগুলার জন্য ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট লাগে। পড়ার বইয়ের রেফারেন্সের থেকে আমাদের গোত্রের বেশি দরকার হয় একটু এক্সট্রা স্নেহ-ভালোবাসা-এ্যাটেনশন-মোটিভেশনের। একটু বোঝানো দরকার পড়ে যে, 'তোমার জন্য আলাদা জায়গা তুলে রাখা আছে'। এইটুকু ছাড়া আমাদের ধরে রাখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস থেকেই ম্যাডাম আমাকে এইটুকু দিয়েছেন। খুব যে কিছু একটা করে দেখিয়ে সেটা ফেরত দিতে পেরেছি, তা বলবো না অবশ্য।
ম্যাডাম ক্লাসে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প বলতেন, আমি ব্যস্ত থাকতাম সেগুলি নিজের জীবনের সাথে মেলাতে। গল্প শেষ হলে বুঝতাম উনি আসলে একটা ইউনিট পড়ানো শেষ করে দিয়েছেন। গল্পটুকু এ্যাকাডেমিক ভাষায় উদাহরণ হিসেবে তত্ত্বের সাথে লিখলেই এ ক্লাস পরীক্ষার উত্তর তৈরী হয়!
পরের ব্যাচ ভর্তি হয়েছে। নবীন বরণ করতে হবে। ইউনিক কিছু করতে হবে। ভাষাশিক্ষার অগ্রজ সব ব্যাচ থেকে ভাইয়া আপুরা আসবেন, কিন্তু ১৬কে ১৫ই বরণ করবে, ম্যাডামের আদেশ! ১৫র থেকে মূল প্রোগ্রাম যাবে। কিন্তু কি যাবে! কোন কুক্ষণে মুখ দিয়ে লাইট এ্যান্ড সাউন্ডের কথা বের করেছিলাম, ম্যাডাম সেই নিয়েই পড়লেন। পড়লেন এবং আদায় করে ছাড়লেন। সব শেষে চেয়ার টানাটানির সময় আমাদের বললেন ৩য় শ্রেণির কর্মচারীদের সাথে হাত লাগাতে, বিভাগের প্রোগ্রামে শ্রেণিতফাত যেন চোখে না পড়ে।
তার কয়েক সেমিস্টার পরের কথা। আমরা জেনে গিয়েছি ম্যাডাম বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন- আনিসুজ্জামান স্যারদের মত মস্তান লোকদের পেয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। সেদিন আমাদের সাহিত্যের ক্লাসের প্রথম দিন। রোল কল শেষে বিরাট প্রশান্তির শ্বাস ফেলে বললেন 'সাহিত্য যে কী, এ আমি তোমাদের জিজ্ঞেসও করবো না, নিজে থেকে বলেও দিবো না, আমরা একসাথে আবিষ্কার করার চেষ্টা করবো।' সেদিন বাইশে শ্রাবণ ছিলো। ম্যাডাম সবার থেকেই একটা করে রবীন্দ্রসংগীত শুনলেন। শেষে অনুরোধে নিজে গাইলেন 'আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে'। সাহিত্য কী, বুঝতে আর বাকি থাকে?
এর পর বিভিন্ন ডামাডোলে ম্যাডাম, ম্যাডামের বিভাগ ছেড়ে চলে গিয়েছি। ব্যাখ্যা করেও যেতে পারিনি কেন গিয়েছি। চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস টের পেয়েছি, অভিমান টের পেয়েছি। নিজেকে 'স্নেহ-হারাম' মনে হয়েছে। কিন্তু অনুতাপে বিভাগের আশ-পাশ দিয়ে যাওয়াও বন্ধ ছিলো বেশ অনেক বছর। মাস্টার্সেও ফেরা হয় নি বিভাগে। এমন কয়েকটা বছর গিয়েছে বসন্ত-বৈশাখে সৌজন্য সাক্ষাত ছাড়া ম্যাডামের সাথে কথা বলার সুযোগ হয় নি। মাঝে ম্যাডাম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জুনিয়রদের থেকে শুনলাম ক্লাস নিচ্ছেন না। তার পর একদিন এলেন, সিড়ি ভেঙে উঠতে পারছিলেন না। সেই দৃশ্য যে কী কষ্টের, কী ভাষায় বলি। ফোন করতে চেয়েছি কতবার, চোখে পানি এসে গিয়েছে, পরে ভেবেছি আমার ফোনে তো সুস্থ হয়ে যাবেন না, প্রার্থনাই বরং ভাল। ঈশ্বর প্রার্থনা শুনেছেন। দূর থেকে দেখেছি ম্যাডাম আবার আগের মত মজার একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন। এইতো সেদিন বললেন সংগঠনের মিটিং-এর জন্য তার বাসায় হজির হতে, যতক্ষণ খুশি থাকবো। আমাদের পরিকল্পনা আছে, একদিন জাকিয়েই হাজির হয়ে যাবো! এখন দেখা হলেই কিছু একটা করে ফেলেছি কিনা এমন একটা আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, 'কী করছো এখন?' আপনার এই আশার জোরেই একদিন দেখা যাবে সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিয়ে কিছু করিয়ে নিয়েছেন! সেদিন প্রথম আপনাকেই জানাবো।
এখন বড় হয়ে যেতে হচ্ছে, নিষ্ঠুর জগতটার মুখোমুখি হয়ে প্রতিদিনই একাধিকবার রক্তাক্ত হতে হচ্ছে, মাথা হেট হতে হচ্ছে, নিয়ত বুঝতে পারছি এই জগতে আলাদা করে কেউ বুঝতে আসবে না আমাকে, আলাদা করে তুলে রাখা ভালোবাসার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরও জানি এক জনের স্নেহ এবং আশীর্বাদ সব সময় মাথার উপর আছে, আলাদা করে তুলে রাখা। এখন বুঝি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা ধরিয়ে দিলেই এ্যাকাডেমিক কাজ শেষ হয়ে যায় না, ছাত্র-ছাত্রীগুলিকে অবুঝ পোষা প্রাণীর মত নিঃশর্ত ভালোবাসা দিয়ে আশ্রয় দিতে হয়, তখনই তারা সত্যি সত্যি বড় হবার স্বপ্ন দেখতে পারে।
এতক্ষণ যার গল্প করছিলাম, ম্যাডামের জন্মদিন আজ। কথা বলায় খুব একটা ভালো না হওয়ায় কারণে নীল বইতেই লিখলাম, এত মমতা দিয়ে সব কিছু কীভাবে ধরে রাখেন বলবেন? বছরের পর বছর কীভাবে এত সবুজ থাকছেন? পঙ্কিল পৃথিবীতে কীভাবে এত শুদ্ধ থাকা যায়, আরেকবার শেখাবেন?
শুভ জন্মদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রথম অধ্যাপক, অনুপ্রেরণাদাত্রী, মমতাময়ী, চিরসবুজ শ্যামলী আকবর ম্যাডাম।

1 comment: