Tuesday, December 20, 2016

বিউটি বোর্ডিং

১ নং শ্রীশ দাস লেন। সন্ধ্যে বেলা জ্বালানো হয়েছে হলুদ বাতি, আলো আঁধারীর খেলা। ভেবে দেখুন আপনার পাশে বসেই চায়ের কাপে আড্ডা জমিয়েছেন শামসুর রাহমান, আহমেদ ছফা, জহির রায়হান, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ এবং শহীদ কাদরীরা। জায়গাটা পঞ্চাশের দশকে ছিলো দৈনিক সোনার বাংলা পত্রিকার অপিস। নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের বাসভবন। দেশভাগের সময় পত্রিকা চলে গেল ওপার বাংলায়, আর জমিদারের থেকে পাইক-পেয়াদাদের ব্যবহৃত ভবনের একটা অংশ দু'ভাই, প্রহাদ চন্দ্র সাহা আর নলিনী মোহন সাহা, খুললেন বিউটি বোর্ডিং।

দো'তলা ইংরেজি টি আকৃতি'র বাড়ি, নিচ তলায় এক অংশে খাবার ঘর, বাকি ঘর গুলিতে বসবাসের ব্যবস্থা। হলুদ রঙ করা বুড়ো দেয়াল, গাছপালার ছায়াঘেরা ছিমছাম কম্পাউন্ড। একটা দপ্তর কামরা আছে, ভেতরে কাঠ-খোদাই পুরোনো আসবাব। তাতে হিসেব-নিকেশে মশগুল তারক সাহা। তিনি বললেন, যুদ্ধের সময় বাবা প্রহাদ সাহাকে মেরে ফেলে এই বোর্ডিং-এই। জ্যাঠা, মা, সমর আর তারক দু'ভাই ভারতে পালিয়ে বাঁচেন। '৭২-এ আবার তাঁরা ফিরে এসে চালু করেন বোর্ডিং। সেই থেকে চলছে আড্ডা, সাথে ভোজন।

কফি হাউজ নিয়ে মান্না দে গান গেয়ে গেছেন ঠিকই, বিউটি বোর্ডিং-এর কথা কেউ মনে রাখে নি। প্রথম বাংলা ছবি 'মুখ ও মুখোশ'-এর পান্ডুলিপি রচিত হয়েছে বিউটি বোর্ডিং-এর আঙ্গিনায় বসে, পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের হাতে। সব্যসাচী সৈয়দ হক তাঁর 'অনুপম দিন', 'সীমানা ছাড়িয়ে'র মত উপন্যাস লিখে গিয়েছেন এখানে বসে। পাঁচ-পাঁচটে বছর এই বোর্ডিং ছিল কবি নির্মলেন্দু গুণের গৃহ। জুয়েল আইচ ঢাকায় এসে প্রথম আস্তানা গেড়েছিলেন এই বোর্ডিং-এ। তবে এই সংষ্কৃতি চালু প্রথম হয় শহীদ কাদরীর হাত ধরে। এখানে অবস্থানকালে কবি তাঁর এক বন্ধুকে চা-আড্ডার দাওয়াত দিয়েছিলেন।

এখন আর আড্ডা চলে না? কবি সাহিত্যিকরা আসেন না? না। এখন বিউটির সেই জৌলুস নেই। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বোদ্ধারাএখন বসেন বেঙ্গলে, ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে, বা দৃকে অথবা অন্য কোথাও। কিন্তু ফি বছর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যার একটা ক্লাস হয় বিউটি বোর্ডিং-এ। এছাড়া দিনে ভিড় জমে থাকে বাংলাবাজারের প্রকাশনাকর্মীদের ভোজনবিলাসে। আগের মত জমজমাট রাত্রিযাপন নেই। তারপরও মাথাপিছু ছ'সাতশ' টাকায় একটা দল বুকিং দিয়েছে থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করবে, সাথে থাকব কাবাব পোড়ানো। তবে দলে নারী সদস্য থাকলে বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা পালন করা হয় বিউটিতে।

তারক সাহা বললেন শিল্প-সাহিত্য-সংষ্কৃতির চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে বেশ, পুঁজির বাজারে মনের খোরাক পুরোনোর চাহিদা উবে যাওয়ার সাথে সাথে উবে যাচ্ছে উৎকৃষ্ট আড্ডার সংষ্কৃতি। বাংলাবাজারের রাস্তা ধরে ১ নং শ্রীশ দাস লেনে যাবার সময় চোখে পড়বে মওলা ব্রাদার্স, আজাদ প্রোডাক্টস, এমদাদিয়া বুক হাউজ, বেঙ্গল স্টেশনারি সহ বহু পুরাতন এবং ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের নাম। কাছেই সুবাস বিলোচ্ছে সুপ্রাচীন ক্যাফে কর্নারের মাটন ক্রাম্ব চপ। ঘিঞ্জি রাস্তায় শীতের সন্ধ্যের আলো ডোবার সাথে আপনি টের পাবেন মৃদু আর্দ্র বাতাস ছুয়ে যাচ্ছে, অদূরেই বয়ে যাচ্ছে ঢাকার কালের সাক্ষী বুড়িগঙ্গা। তার স্রোত বহন করছে শতাধিক বছরের পুরোনো এক নগরীর গল্প। সে কথা আরেক দিন হবে।



Tuesday, December 6, 2016

একটা সাবঅলটার্ন গল্প

মাঝে মাঝে দ্রোহ ভর করে। দু'পাঁচ মিনিট আস্ফালন করে। তার পর লেজ গুটিয়ে গর্তে পালায়। হাঁটুভাঙ্গা মেরুদন্ডবিহীন ব্যক্তিত্বহীনতা সদর্পে মঞ্চে ফিরে আসে। তার সে যে কি দোর্দন্ড প্রতাপ! তবে স্ট্রিং থিওরি বলে যে সব ডেটা এনক্রিপ্টেড থাকে। খুব অল্প কিছু সময় মনে হয় ঝড়-টড় আসলেই একদিন থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে, বিকেলে আমরা ব্যালকনি বা উঠোনে বসে মেলামাইনের কাপে লাল চা আর মুড়ি খাবো। বিড়ালটা ঝিমোবে। অথবা যে চিলটা দিনমান আকাশে গোল করে চক্কর খায়, কালারব্লাইন্ড আমি তার রঙ বুঝতে পারবো না। তার পর সন্ধ্যে হলে গাছের ফাঁক দিয়ে ল্যাম্প পোস্টের মৃদু হলদেটে আলো আসবে, কিন্তু সামনের বাড়ির মাস্টারনী প্রাইভেট পড়িয়ে বাসায় ফিরে রিক্সাভাড়া দিতে পারবে না। অথবা আমরা নক্ষত্রের রাত দেখবো না, আগেই ঘুমিয়ে পড়বো, অসম্ভব মায়াময় একটা ভোরের স্বপ্ন নিয়ে যাতে কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে সরু একটা রশ্মি মার্কিন কাপড়ের বিছানার চাদরে খেলা করে। কিন্তু কোন একটা কারণে সাড়ে ছয়টার এ্যালার্মটা কেন যেন বন্ধই করা যাবে না। নস্ট্রাডামাস এর ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হয় নি যে। তবে একটা তারা খসে গিয়েছিলো, সে কথা দো'তলা-নিচতলার সবাই মনে রেখেছিলো। আর মনে রেখেছিলো কমলা রঙের হকি-স্টিক দিয়ে ক্রিকেট খেলা। মনে রাখেনি হারিয়ে যাওয়া ব্যাঙের ছানাটার কথা। অথবা মুকুলের কথা। অথবা পরম নির্ভরতার গৃহের গন্ধটার কথা।

শান্তি বর্ষিত হোক, মঙ্গল বিরাজ করুক।

Monday, October 31, 2016

ননসেন্স ডিমপোচ



রুটিনমাফিক চলার বিষয়টা জেলবন্দীর মত অনুভূতি দেয়। শরীর, মন, কাজ ঠিক রাখার জন্য প্রত্যেকদিন আমাকে একই নিয়মে চলতে হবে, এটা শাস্তি ছাড়া আর কী? নিয়ম করে খাওয়া ঘুমুনোর বাধ্যবাধকতা যখন থেকে আরোপিত (ঘাড় ধরে ট্র্যাকে তোলার চেষ্টা) তখন থেকেই নিজেকে একটু অন্য ভাবে ট্রেইন করে তোলার ইচ্ছে ছিলো। আই উইল বি দ্য মাস্টার অফ মাইসেলফ টাইপের একটা গোয়ার্তুমি ধরে বসেছিলো। নিয়ন্ত্রণটা অনেকটুকু নিয়েও ফেলেছিলাম। যখন খুশী, যতক্ষণ খুশী জাগবো, বদলে কম্পেনসেশন/ভর্তুকি/ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক্সট্রা যতটুকু খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন, খেয়ে নিবো। নিজেকে এই ট্রেইনিংটা দিতে গিয়ে একটা অদ্ভূত ক্রাইসিসের ভেতর পড়ে গেলাম। যেখানে আসলে কনসেন্ট্রেশন রয়েছের থেকেও যেখানে কনসেন্ট্রেশন দেওয়া লজিক্যালি প্রয়োজন সেখানটাতে মনযোগ দেওয়া শুরু করলাম। যেই কাজে আসল আগ্রহ নেই, সেখানেও মনযোগ দিয়ে কৃত্তিম আগ্রহ সৃষ্টি করে এ গ্রেডের কাজ বের করে আনতে শুরু করলাম। এর পেছনে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষা ব্যবস্থার যে কোন ভূমিকা ছিলো না তা নয়। টেন্ডেন্সি যাই হোক না কেন, টেক্সট বুক যাই হোক না কেন, সিস্টেম যাই হোক না কেন, রেজাল্টটা ঠিক থাকা চাই, হোক তাতে যে কোন ক্ষতি। ক্ষতির বদলে যা পাওয়া তাতে যাবে পুষিয়ে। এই করে যেটা হলো, মোজার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভেতরের দিকটা বাইরে বের করে নিয়ে আসলে যেমন হয়, আমার নিজের অবস্থা দাঁড়ালো তাই। ইনসাইড আউট। যেটা সম্পূর্ণই সামঞ্জস্যহীন! 

‘সামঞ্জস্যহীন’ বিষয়টা আরেকটু ভেঙ্গে বলা দরকার। মানে আমি আসলে যে মানুষটা, আমার যা বৈশিষ্ট্য, মানসিকতা, চিন্তা ভাবনা, দর্শন, ইত্যাদি পাল্টে অন্য কিছু একটাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়ার ভেতর ঢুকে পড়া হলো। এর ফলে আমি হয়ে গেলাম না ইধার-কা, না উধার-কা। আমি আমি-ও থাকলাম না, আমি অন্য কেউ-ও হয়ে গেলাম না! মাঝামাঝি একটা দোটানায় পড়ে যাওয়া ছাব্বিশোর্ধ তরুণ। এর ফলে আমার ভেতর দেখা দিলো মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। একেক সময় আমি একেক মানুষ, একেক পরিস্থিতিতে আমার বৈশিষ্ট্য একেক রকম। বহুরূপী আর কি। পুরো ব্যাপারটা যত আর্টিস্টিক, বর্ণিল আর আনন্দদায়ক শোনাচ্ছে, ভিক্টিমের জন্যে আসলে এটা ততটাই কষ্টদায়ক। নাটকীয় ভাষায় বললে অভিশাপস্বরূপ আর কি। অভিশাপের কারণটা হলো, আমি নিজে আসলে কে সেটা হারিয়ে গেছে। আমি আসলে কী সেটা বিস্মৃত। 

ধরেন, মানুষ ইন্ট্রোভার্ট হতে পারে, বা এক্সট্রোভার্ট হতে পারে। আমার চিন্তা ভাবনা জড়তা সব একজন ইন্ট্রোভার্টের মতন, কিন্তু সামাজিক পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে ভয়াবহ একটা মানসিক কষ্টের ভিতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে আমূল ট্রান্সফর্ম করে কাজ চালানোর মত এক্সট্রোভার্ট হয়ে যাই! এই প্রক্রিয়া সারা দিনে এতবার চালাতে হয়, হয়েছে, যে আমি ভুলে গিয়েছি আমি আসলে কে! আবার মনে করেন আমি পছন্দ করছি একজন হিপ্পি ধরণের মানুষের সাথে ওঠা বসা, কিন্তু আমার ভিতরের প্রায় অর্ধাংশ (বা তার একটু বেশি) অংশ সারাক্ষণ চাপ দিয়ে যাচ্ছে নিয়মমাফিক চলাফেরা করা প্রগ্রসিভ ভালো ছাত্র গোছের কারো একজনের সাথে মেশার জন্য। আবার কোন কোন সময় আরও অদ্ভূত সমস্যার উদ্ভব হয়। বাউন্সিং। ধরেন আমার এখন একটা লেখা শেষ করতে হবে, যেটা আমার মোটেই ইচ্ছে করছে না, আমার মাথায় ঘুরছে কোন একটা টিউন যেটা না তুললে আমারে পীড়া দিতেই থাকবে। গিটার নিয়ে যখন গুছিয়ে বসবো তখন আবার অন্য অংশ ডোমিন্যান্ট হয়ে গিয়ে চাপ দেওয়া শুরু করবে ‘এগুলো কী করছো? তোমার তো লেখার কথা এখন! লেখা শুরু করো, ফেলো এগুলো!’ নিজের উপর বিতশ্রদ্ধ হয়ে সব ফেলে লিখতে বসলে কী লেখা আর বেরোয়? নিজের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমি তখন কোন টিউন-লেখা দুই-ই ফেলে ঘুমুতে চলে যাই। ঘুমের ভেতর মাথায় বাজতে থাকে টিউন! কিন্তু টিউন তুলে জীবিকা নির্বাহের জন্য যেই সাধনা করার দরকার ছিলো, তা-ও নেই, জীবিকার যেই রাস্তা আরোপিত সেই পথও বহু দূর! 

তো এই দোটানা/ত্রিটানা/বহুটানা’র ভিতর পড়ে আমার এখন একক কিছু হওয়ার সাধ এবং সাধ্য দুই-ই চলে গিয়েছে। কোন একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে পড়ে যাওয়াটা বীভৎস মনে হয়। কোন কিছু একটা করতেই হবে এমন মনে হলেই সেই কাজ থেকে মন উঠে যায়। এই মাত্র মনে হলো এই লেখাটা ঠিক ভাবে শেষ করাটা আমার কাজ। যে মনে হওয়া, সেই মাত্রই আর লিখতে ইচ্ছে করলো না, ইতি টানলাম। এই সমস্যা, নিজের সাথে যুদ্ধ করার বিষয়টা হয়তো সবারই আছে, কিন্তু সবাই যেটা করা দরকার সেখানে ফোকাস করতে পারেন, আমার সেই অক্ষমতাটুকু আছে। কিন্তু সে যে কী যন্ত্রণা, তা আমার দুর্বল ভাষাদক্ষতা দিয়ে বোঝানো সম্ভব না। কেমন হলে ভালো হতো, সেইটে ভুলে গিয়েছি।

পুরা সমস্যাটা আমি যেমন খানিকটা মানসিক রোগের ফ্লেবার দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করলাম, আসলে তেমনটা না-ও হতে পারে। হতে পারে আমি আসলে একটা ননসেন্স ফাতরা, যাকে দিয়ে আসলে কিছুই সম্ভব নয়! হা হা!

Image result for broken egg
চিত্রঃ ভেঙ্গে যাওয়া সম্ভাবনাময় একটি ডিম কে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত সুস্থ দু'জন ডিম
[কৃতজ্ঞতাঃ এইজলিং ও'কনর এর ফ্লিকার]

Sunday, June 12, 2016

দালি'র হাতিরা এবং সেদিনকের ঘটনাটা...

হয়েছে কি, কী একটা যেন পড়তে গিয়েছিলাম। পড়া শেষ করে বেরিয়ে অপূর্ব ফোন দিলো। জরুরী তলব। বাসায় না গিয়েই ওর বাসার আশেপাশে দেখা করলাম। ও গলা নামিয়ে বললো 'এই এই' হলো ঘটনা। আমিও আর কাল বিলম্ব না করে রাস্তায় সবার সামনেই (এবং সবার অলক্ষ্যে) চোখের নিমেষে খাকি ইউনিফর্ম বুট-টুট পরে নিলাম, অপূর্ব-ও। আমাদের দু"জনেরই পুরনো কিন্তু অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রীয় (থ্রি-নট-থ্রি'র মত দেখতে) হাতিয়ার। কাঁধে বই খাতার ভারী ব্যাগ এবং ইউনিফর্ম-বুট-হাতিয়ার নিয়ে আমরা দু'জন দু'দিকে ছড়িয়ে গেলাম। এর মধ্যে অবশ্য আরেকবার দেখা হয়েছিলো, কাকে যেন তাড়া করতে গিয়ে আমরা একটা গলিতে ঢুকে গেলাম, তারপর একটা অন্ধকার বাড়ির খিড়কি দিয়ে উঠে কাকে যেন অস্ত্র-শস্ত্র দেখিয়ে আর চিৎকার করে ভয় দেখিয়ে আসলাম।

বেশিক্ষণ সময় লাগলো না, রুবিক'স কিউবটা আমিই খুজে পেলাম। হঠাত দেখি রিক্সা চেপে অপূর্ব আসছে, রিক্সার ধাক্কায় পড়ে গেলাম। গিয়েই আমার (জীবনে প্রথমবারের মত) আমার অস্ত্রটা লোড করে ওর দিকে তাক করে ঘোড়া টিপে দিলাম, অনেক বার। গুলিগুলো ওর মুখের মধ্যে ঢুকে গেলো আর ও তেমন ভীতি কর কিছু করতে পারলো না। ওকে ফেলে হাউজিং-এর দিকে রওনা হলাম। হওয়ার পথে মনে হলো হায় হায় ওর কাছে তো অস্ত্র বা ইউনিফর্ম কিছুই ছিলো না, মারলাম কেন? যেই মনে হওয়া অমনি ফোন দিলাম, 'দোস্ত কই তুই, গেটের সামনে আয়।' চলে এলো। ওর বাসায় উঠলাম, উঠে অপরাধবোধে আমি তেমন কিছু বলছি না, ও-ও নরমাল। হঠাত দেখি আমাদের দুর্ধর্ষ ঘটনাটা নিউজ হয়ে গিয়েছে অনলাইনে। আমরা একই সাথে চিন্তিত এবং আনন্দিত হয়ে পড়লাম। হঠাত কি হলো আমি ওকে জড়ায়ে ধরে 'ভাই আমার, তোকে আমি কিভাবে শ্যুট করতে পারলাম, বেশি ব্যথা পাসনি তো?' বলে কেঁদে ফেললাম।

এই করতে করতে দেখি রাত হয়ে গেছে। এক রাশ সাফল্য, চাপা আনন্দ, ভীতি নিয়ে আমরা রাস্তায় নামলাম। ওকে বললাম, নিউজগুলা দেখতে তো মজাই লাগছে, থেকে যাবো নাকি তোর বাসায় রাতে? ও বললো আমাকে রিক্সে করে বাড়ি দিয়ে আসবে। রিক্সা খোঁজার জন্য নির্জন রাস্তায় হাঁটছি, হঠাত একটা রিক্সা-ও এলো, সাথে দু'পাশ দিয়ে দু'জন লোকও এলো। অপূর্ব বললো ও উঠছে, কিন্তু আমার ডান পাশে উঠে বসলো চেক শার্ট পরা গাট্টা-গোট্টা লোকটা, খানিকটা ভয়ই পেলাম। তারপর একটা মোড় আসতেই বললাম 'আপনি যাবেন কই?' লোকটা বললো 'ক্রিসেন্ট লেক'। এই মাঝরাত্তিরে ক্রিসেন্ট লেক (যদিও আমার বাসার কাছেই)! একটা মোড় আসতেই বললাম 'আচ্ছা তবে, আমি ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি, এখানেই নামবো, আপনি চলে যান, স্লামালিকুম।' মানিব্যাগ বের করে দেখি অসংখ্য পাঁচ টাকার নোট, গুণে দিতে সময় লাগলো।

এখন কী করি? কোথায় নামলাম চিনতেও পারছি না। রিক্সেও পাচ্ছি না। খালি বসে আছে, কিন্তু আমি জানি যাবে না, কই যেন লেখা আছে। দাঁড়িয়ে আছি, অনেক রাত হয়েছে, কিন্তু একটু একটু সূর্য উঠছে। এক লোক একটা চপার টাইপের মোটরসাইকেল চালিয়ে এসে আমার সামনেই রাখলো, রেখে কই যেন হাওয়া হয়ে গেলো। অগত্যা আর কি করা, পকেট থেকে চাবি বের করে, ভারী ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে (জীবনে প্রথমবার) বাইক চালিয়ে বাসায় চলে এলাম। শুধু চলেই যে এলাম তা নয়, লিফটে একেবারে ৬ তলার সিঁড়িঘরে তুলে ফেললাম, এখন মনে হলো, ফেরত দিবো কীভাবে? তারপর সিড়িঘরে (যদিও বাতি জ্বলছিলো না) সুইচ নিবিয়ে বাসায় ঢুকলাম, পিপ-হোল দিয়ে দেখি বাইকের উপর কে যেন একটা হলদেটে তোয়ালে মেলে রেখে গেছে। বাঙ্গালী!

ঘরে এসে ঘুমুবো, হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেলো।