রুটিনমাফিক চলার বিষয়টা জেলবন্দীর মত অনুভূতি দেয়। শরীর,
মন, কাজ ঠিক রাখার জন্য প্রত্যেকদিন আমাকে একই নিয়মে চলতে হবে, এটা শাস্তি ছাড়া আর
কী? নিয়ম করে খাওয়া ঘুমুনোর বাধ্যবাধকতা যখন থেকে আরোপিত (ঘাড় ধরে ট্র্যাকে তোলার চেষ্টা)
তখন থেকেই নিজেকে একটু অন্য ভাবে ট্রেইন করে তোলার ইচ্ছে ছিলো। আই উইল বি দ্য মাস্টার
অফ মাইসেলফ টাইপের একটা গোয়ার্তুমি ধরে বসেছিলো। নিয়ন্ত্রণটা অনেকটুকু নিয়েও ফেলেছিলাম।
যখন খুশী, যতক্ষণ খুশী জাগবো, বদলে কম্পেনসেশন/ভর্তুকি/ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক্সট্রা যতটুকু
খেয়ে নেওয়া প্রয়োজন, খেয়ে নিবো। নিজেকে এই ট্রেইনিংটা দিতে গিয়ে একটা অদ্ভূত ক্রাইসিসের
ভেতর পড়ে গেলাম। যেখানে আসলে কনসেন্ট্রেশন রয়েছের থেকেও যেখানে কনসেন্ট্রেশন দেওয়া
লজিক্যালি প্রয়োজন সেখানটাতে মনযোগ দেওয়া শুরু করলাম। যেই কাজে আসল আগ্রহ নেই, সেখানেও
মনযোগ দিয়ে কৃত্তিম আগ্রহ সৃষ্টি করে এ গ্রেডের কাজ বের করে আনতে শুরু করলাম। এর পেছনে
আমাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং শিক্ষা ব্যবস্থার যে কোন ভূমিকা ছিলো না তা নয়। টেন্ডেন্সি
যাই হোক না কেন, টেক্সট বুক যাই হোক না কেন, সিস্টেম যাই হোক না কেন, রেজাল্টটা ঠিক
থাকা চাই, হোক তাতে যে কোন ক্ষতি। ক্ষতির বদলে যা পাওয়া তাতে যাবে পুষিয়ে। এই করে যেটা
হলো, মোজার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভেতরের দিকটা বাইরে বের করে নিয়ে আসলে যেমন হয়, আমার নিজের
অবস্থা দাঁড়ালো তাই। ইনসাইড আউট। যেটা সম্পূর্ণই সামঞ্জস্যহীন!
‘সামঞ্জস্যহীন’ বিষয়টা আরেকটু ভেঙ্গে বলা দরকার। মানে আমি
আসলে যে মানুষটা, আমার যা বৈশিষ্ট্য, মানসিকতা, চিন্তা ভাবনা, দর্শন, ইত্যাদি পাল্টে
অন্য কিছু একটাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়ার ভেতর ঢুকে পড়া হলো। এর ফলে আমি হয়ে গেলাম না
ইধার-কা, না উধার-কা। আমি আমি-ও থাকলাম না, আমি অন্য কেউ-ও হয়ে গেলাম না! মাঝামাঝি
একটা দোটানায় পড়ে যাওয়া ছাব্বিশোর্ধ তরুণ। এর ফলে আমার ভেতর দেখা দিলো মাল্টিপল পার্সোনালিটি
ডিজঅর্ডার। একেক সময় আমি একেক মানুষ, একেক পরিস্থিতিতে আমার বৈশিষ্ট্য একেক রকম। বহুরূপী
আর কি। পুরো ব্যাপারটা যত আর্টিস্টিক, বর্ণিল আর আনন্দদায়ক শোনাচ্ছে, ভিক্টিমের জন্যে
আসলে এটা ততটাই কষ্টদায়ক। নাটকীয় ভাষায় বললে অভিশাপস্বরূপ আর কি। অভিশাপের কারণটা হলো,
আমি নিজে আসলে কে সেটা হারিয়ে গেছে। আমি আসলে কী সেটা বিস্মৃত।
ধরেন, মানুষ ইন্ট্রোভার্ট হতে পারে, বা এক্সট্রোভার্ট হতে
পারে। আমার চিন্তা ভাবনা জড়তা সব একজন ইন্ট্রোভার্টের মতন, কিন্তু সামাজিক পরিস্থিতিতে
আমি নিজেকে ভয়াবহ একটা মানসিক কষ্টের ভিতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে আমূল ট্রান্সফর্ম করে কাজ
চালানোর মত এক্সট্রোভার্ট হয়ে যাই! এই প্রক্রিয়া সারা দিনে এতবার চালাতে হয়, হয়েছে,
যে আমি ভুলে গিয়েছি আমি আসলে কে! আবার মনে করেন আমি পছন্দ করছি একজন হিপ্পি ধরণের মানুষের
সাথে ওঠা বসা, কিন্তু আমার ভিতরের প্রায় অর্ধাংশ (বা তার একটু বেশি) অংশ সারাক্ষণ চাপ
দিয়ে যাচ্ছে নিয়মমাফিক চলাফেরা করা প্রগ্রসিভ ভালো ছাত্র গোছের কারো একজনের সাথে মেশার
জন্য। আবার কোন কোন সময় আরও অদ্ভূত সমস্যার উদ্ভব হয়। বাউন্সিং। ধরেন আমার এখন একটা
লেখা শেষ করতে হবে, যেটা আমার মোটেই ইচ্ছে করছে না, আমার মাথায় ঘুরছে কোন একটা টিউন
যেটা না তুললে আমারে পীড়া দিতেই থাকবে। গিটার নিয়ে যখন গুছিয়ে বসবো তখন আবার অন্য অংশ
ডোমিন্যান্ট হয়ে গিয়ে চাপ দেওয়া শুরু করবে ‘এগুলো কী করছো? তোমার তো লেখার কথা এখন!
লেখা শুরু করো, ফেলো এগুলো!’ নিজের উপর বিতশ্রদ্ধ হয়ে সব ফেলে লিখতে বসলে কী লেখা আর
বেরোয়? নিজের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত আমি তখন কোন টিউন-লেখা দুই-ই ফেলে ঘুমুতে চলে
যাই। ঘুমের ভেতর মাথায় বাজতে থাকে টিউন! কিন্তু টিউন তুলে জীবিকা নির্বাহের জন্য যেই
সাধনা করার দরকার ছিলো, তা-ও নেই, জীবিকার যেই রাস্তা আরোপিত সেই পথও বহু দূর!
তো এই দোটানা/ত্রিটানা/বহুটানা’র ভিতর পড়ে আমার এখন একক কিছু
হওয়ার সাধ এবং সাধ্য দুই-ই চলে গিয়েছে। কোন একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে পড়ে যাওয়াটা বীভৎস
মনে হয়। কোন কিছু একটা করতেই হবে এমন মনে হলেই সেই কাজ থেকে মন উঠে যায়। এই মাত্র মনে হলো এই লেখাটা ঠিক ভাবে শেষ করাটা আমার কাজ। যে মনে হওয়া, সেই মাত্রই আর লিখতে ইচ্ছে করলো না, ইতি টানলাম। এই সমস্যা,
নিজের সাথে যুদ্ধ করার বিষয়টা হয়তো সবারই আছে, কিন্তু সবাই যেটা করা দরকার সেখানে ফোকাস
করতে পারেন, আমার সেই অক্ষমতাটুকু আছে। কিন্তু সে যে কী যন্ত্রণা, তা আমার দুর্বল ভাষাদক্ষতা
দিয়ে বোঝানো সম্ভব না। কেমন হলে ভালো হতো, সেইটে ভুলে গিয়েছি।
পুরা সমস্যাটা আমি যেমন খানিকটা মানসিক রোগের ফ্লেবার দিয়ে
সাজানোর চেষ্টা করলাম, আসলে তেমনটা না-ও হতে পারে। হতে পারে আমি আসলে একটা ননসেন্স
ফাতরা, যাকে দিয়ে আসলে কিছুই সম্ভব নয়! হা হা!
চিত্রঃ ভেঙ্গে যাওয়া সম্ভাবনাময় একটি ডিম কে দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত সুস্থ দু'জন ডিম [কৃতজ্ঞতাঃ এইজলিং ও'কনর এর ফ্লিকার] |
No comments:
Post a Comment