Wednesday, August 27, 2014

এই শহরে...


শহর এক অদ্ভূত বিষয়। শহরে মিশে যাওয়ার একটা ব্যপার আছে। কাকতালীয়ভাবেই পর পর কোন বই পড়তে আর সিনেমা দেখতে গিয়ে এই ধারণা আরও পোক্ত হলো। পুরাটা শহর একটা লিভিং অর্গানিজমের মত। মানুষ-দোকানপাট-ঘরবাড়ি-গাড়িঘোড়া সবই নিজের নিজের মত চলছে, আপনি হয়তো সেগুলোর কোন একটা হবেন। কিন্তু তারপরও একেকটা শহরের নিজের প্রাণ আছে। নিজের একটা অদ্ভূত ছন্দের স্পন্দন আছে।

কয়েকদিনের খুব ব্যস্ততা শেষ করে কাউকে না জানিয়ে নিয়ম অমান্য করে ঝিরঝিরে বৃষ্টির সন্ধ্যে বেলা প্রেতাত্মার মত যদি বেরিয়ে পড়েন, এই বিষয়টা খেয়াল করতে পারবেন। ধরুন খুব সরু এলোমেলো বৃষ্টির ফোঁটা আপনার চশমার কাচটাকে বিরক্ত করে ফেলছে। অনিয়মিত হাওয়ার মাঝে ওভারব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে খুব দূরে তাকালে কিছুক্ষণ হয়তো হারিয়ে যাবেন অস্পষ্ট ভাবনায়। কিন্তু খানিক্ষণ পার করার পর আপনি নিজেকে আপনার থেকেও বড় কিছু একটার অংশ ভাবতে থাকবেন। সব ছন্দ পতনের মাঝেও দূউউর থেকে আসা বাস-গাড়ি-রিক্সার ঝাঁকের মাঝে রিদমটা খুঁজে পাবেন। আপনার মনে হবে বিশাল এক প্রাণীর শরীরের শিরা-উপশিরার মাঝে বয়ে যাওয়া সঞ্জীবনীপ্রবাহের কি এক ক্ষুদ্র অংশ যেন আপনি। বিচ্ছিন্ন নয় কিন্তু, একেবারেই একাত্ম।    

খুলে রাখা হেডফোনের গান আপনাকে আর আকৃষ্ট করবে না। নতুন এক সঙ্গীত আপনার প্রতিটা কোষ ভেদ করে প্রবেশ করা শুরু করেছে। অফিসে প্রতিদিন দেখা হওয়া মানুষটার সাথে প্রথম দিন তার বাসায় রাতের খাবার খেতে গেলে যেমন চোখ মানিয়ে নেওয়ার একটা অনুভূতি হয়, এই শহর আপনাকে তেমনই এক যাত্রা উপহার দিতে যাচ্ছে। খেয়াল করবেন, ভারী ল্যাপটপের ব্যাগে ভরে চাকরির ঘানি টেনে ফিরছেন কর্মজীবি নারী, বা ঘোর শত্রু কলিগের ঝরঝরে মোটরসাইকেলের পিছনে বসে প্রায়-চুল-পড়ে-যাওয়া প্রৌড় ফিরছেন বাসায়। মুড়ির টিন বাসে ঝুপ করে উঠে পড়বে কোন তরুণ, সন্ধ্যায় ঘুরতে বের হওয়া প্রেয়সীকে রিক্সা করে শহরের অন্য প্রান্তে পৌঁছে দিয়ে আসছে কোন যুবক, বেবিট্যাক্সিতে চোখ গেলে দেখবেন বাবা-মা’র পাশে বসা দুই ঝুটি করা উৎসুক বালিকার দৃষ্টি আপনার দিকেই নিবদ্ধ, পা টেনে টেনে হেঁটে যাওয়া আসক্ত ময়লা-কুড়িয়ের ঘোলা চোখের ভাষা আপনাকে ভুলিয়ে দিবে তাঁর আসক্তি গাঁজায় নাকি এই শহরেই। তেমন সময়ই আপনার সামনে দিয়ে নতুন সুখ সাজানোর স্বপ্নে বিভোর বিয়ের গাড়ি চলে যেতে থাকবে।     

 মাঝরাতের খানিক আগে দিয়ে গিয়ে বসুন বড় রাস্তার পাশের ফুটপাতে কোন একটা ছাপড়া দোকানে। আপনি নির্বিকার বসে আছেন, আলাদা হয়ে। বাকি সবার গতি-ও স্তিমিত হয়ে আসছে। সুবিশাল প্রাণী সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে এবার বিশ্রাম চায়, ঢিলে হয়ে আসছে তার প্রশ্বাস, তার রক্তপ্রবাহ। কিন্তু নিদ্রা মানে তো মৃত্যু নয়, নিদ্রাকালেও প্রাণী জীবিত থাকে। বিশ্রামের সময়ও তার জীবনের স্পন্দন দেওয়ার জন্য হাজির হয় রাতের প্রবাহ। সাঁই সাঁই করে মাঝরাস্তা দিয়ে ছুটে চলা দূরপাল্লার বাসগুলির পাশে হঠাত দেখবেন ফিনিক্স সাইকেলে করে ঢিমে তালে চলে যাওয়া কাউকে। আপনার দৃষ্টির সীমায় প্রবেশ করা থেকে শুরু করে সীমানার বাইরে বের হয়ে যাওয়ার সময়টুকু কম নয়। কিন্তু একতা তাল আছে, একটা ছন্দ আছে। বাসগুলি নয়, রাতের শহরকে বাচিয়ে রেখেছে ঐ ফিনিক্স সাইকেল-চালক।

মাঝরাত্তির পার হলে চলে যান একটা রেল লাইনের ধারে। শহর যদি আপনাকে তার মত করে আপন করে নেয়, তবে সাক্ষাত হবে রাতের ট্রেনের সাথে। অনেক দূরের পোঁ কেমন নিশ্চুপ শহরকে বিরক্ত না করেই বাতাসে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে ঝাকাঝাক-ঝাকাঝাক করে চলে যাবে, একটা শীতল বাতাস-ও কিন্তু ছুঁয়ে যাবে আপনাকে। তখন চাইলে খেয়াল করে দেখতে পারেন ইঞ্জিনের পরের বগির ছাদেই উদোম গায়ের যুবকের গলায় ঝোলানো গামছা উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে প্রবল বাতাসে। চাইলে খেয়াল না-ও করতে পারেন। আরও আপন করে নিতে চাইলে বহুদূরের পোঁ বুঝতে পেরে মাথা নামিয়ে রেল-লাইনের সামনে রাস্তায় কান পাতুন। দেখবেন আপনার শরীরের ভেতর মৃদু ঝাকাঝাক-ঝাকাঝাক শুরু হয়ে গেছে। শিশির বা বৃষ্টির থেকে বাঁচার জন্য নীল পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা ঝুপড়িগুলো-ও কিন্তু এই ঝাকাঝাক-ঝাকাঝাক-এর সাথে একটুখানি তিরতির করে কেঁপে উঠবে।

রাত আরও বাড়লে শহরের নবীন প্রাণের আখড়া, কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বসতে পারেন। শহর যদি প্রসন্ন হয়, তবে আধারাচ্ছন্ন কোনায় জমে ওঠা আসরে দরাজ গলার গায়কের গীটারের তারের ঝংকারে বেঁধে ফেলতে পারে আপনাকে খানিক্ষণ। বহুকাল আগে শোনা কোন একটা গানে আপনাকে আষ্টে-পৃষ্টে জড়িয়ে হঠাৎ যখন বুঝবেন আসরে এক অন্য আড্ডা জমে উঠেছে, তখন বুঝবেন শহর আপনাকে গান শোনানো শেষ করেছে, এবার উঠে পড়ুন। এই সময় স্মৃতি চারণ করতেও পারেন, নাও পারেন। তবে চাঁদটাকে হা করে দেখে নিতে ভুল করবেন না। কেমন এক অদ্ভুত মায়াময় চাঁদটা দেখবেন মেঘের আড়ালে চলে যায়, আবার রহস্য করে আপনাকে এক ঝলক দেখেও নেয়!

শরীর ভারী লাগছে? ঠিক তখনই আর্মেনি-গীর্জায় তিনবার ঢং-ঢং-ঢং শুনবেন। শহরই আপনাকে মধ্যরাত্রি ত্রিপ্রহরের সম্ভাষণ জানালো আপন কায়দায়। অনুভব করুন নিজের প্রতিটা ইন্দ্রীয় দিয়ে।
এখন আপনার এক কাপ চা প্রয়োজন। চায়ের থেকে বেশি প্রয়োজন চায়ের কাপে চামচের শব্দ শোনার। একটা টং দোকান কিন্তু খোলা থাকবে আপনার জন্যই। টং দোকানের সামনেই হাটু মুড়ে আরাম করছে একটা ঘিয়ে রঙের কুকুর। আপনি মৃদু স্বরে চা চাইলে কুকুরটা আপনার দিয়ে আলগোছে একবার তাকাবে। চায়ের কাপে আপনার সচিন্ত চুমুকের মাঝে শহর আপনার শরীরে প্রবেশ করবে। আপনাকে কখন এভাবে নিজের করে নিয়েছে, টের পাবেন না।

“...আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউউউমমমম...” শেষে প্রথম ভোরের আলো ফুটতে দেখলে বুঝবেন শো শেষ, নতুন দিনে আবার আপনাকে শহরের চাহিদা পূরণে দৌড়ুতে হবে। দৌড়ুতে হবে না আসলে, শহরের প্রয়োজনীয় প্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, তখন চলবে না চিন্তা করা। ভোরের প্রথম আভা দেখলে বুঝবেন এই শহর এতক্ষণ আপনার সাথে বন্ধুতা পাতিয়েছিলো। আপন রূপ দেখাতে আসর বসিয়েছিলো। আপনাকে নিয়ে ঘুরে এসেছে নিজেরই গলি-ঘুঁজি। আপনাকে কীভাবে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে, সেই গল্প বলেছে। বলেছে নিজের অজস্র গোপন কথা। আপনার বোধি লাভ হবে, এই শহর এবং আপনি একে অপরের পরিপূরক, দু’জনেরই দু’জনকে প্রয়োজন। 

নতুন একটা আগামীকাল দেখানোর জন্য পুরাতন ছন্দ নতুন করে শুরু করে গ্রাম থেকে আসা শব্জি-বোঝাই ট্রাকগুলি। ভোরের আলো ফুটে যাওয়ার আগেই এই শহরের গন্ধ নাকে পা চালিয়ে চলুন আপনার আপন ডেরার দিকে। এই স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার আগেই সংরক্ষণের জন্য হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিন পীচ ঢালা রাস্তায়, এই শহরে।