Wednesday, January 4, 2017

জায়ান্ট মেগাথ্রাস্ট

ডিসক্লেইমারঃ আমি জিওলজিস্ট নই। আমার পড়াশোনার বিষয় ভূতত্ত্ব নয়। তাই আমার কথায় যথেষ্ট ভুল, সংশয় এবং অপূর্ণতা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, সেগুলি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার এবং শুধরে দেবার অনুরোধ রইলো। ভয় পাওয়ার কারণে আমি ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলো বুঝার ক্ষুদ্র নগণ্য চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে সর্বসাধারণের কনসার্নড হবার সময় এসেছে।

সাধ্যমত তথ্য শেয়ার করা এবং আতংক ছড়ানোর ভিতর পার্থক্য আছে। আমরা আসলে এমন একটা অবস্থানে আছি যা-তে আতংক যে পর্যায়েরই ছড়ানো হবে, মূল ঘটনার ভয়াবহতা তার থেকেও শত-সহস্রগুণে বেশি হবে।

জাফর ইকবাল স্যার বলেছিলেন, কোন বিষয়ে ভয় থাকলে তা নিয়ে পড়াশোনা করলে ভয় কেটে যায়। ভূমিকম্প এবং আমাদের দক্ষিণ এশীয় টেকটনিক প্লেট নিয়ে পড়াশোনা করে আমার ভয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। এখন আমি যতটুকু বুঝেছি সেটুক বলতে গেলে দু'টো সমস্যাঃ ক) এই বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার অভিজ্ঞতা নেই আমার, সুতরাং এর গ্রহণযোগ্যতা প্রায় নেই বললেই চলে; খ) একজন ভূতাত্বিক যত সুন্দর এবং সহজ করে পুরো বিষয়টা প্রকাশ করতে পারবেন, আমি ঠিক তেমন পারবো না, বরং গুলিয়ে ফেলবো।

মূল কথায় আসি। দক্ষিন এশীয় প্লেটটা ঠিক মূল ইউরেশিয়ান প্লেটের অংশ নয়, একটা নৌকার মত ভেসে এসে ইউরেশিয়ার মূল ভূখন্ডে ঠেকেছে (ভেসে আসার ছবি এ্যাটাচড আছে)। এখন নৌকো ডাঙ্গায় ভিড়লে পাড়ের মাটি একটু উঠে আসে যেমন, খানিকটা সেই প্রক্রিয়াতে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি (স্যাটেলাইট ম্যাপের ছবিটাতে লাল চিহ্নিত অংশটুকু)। তো, টেকটনিক প্লেট গুলির তলায় প্রতিনিয়ত লাভা প্রবাহিত হবার কারণে সব গুলি প্লেটই একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সে হিসেবে দক্ষিণ এশীয় প্লেটটা আরেকটু উত্তরে উঠে ইউরেশিয় প্লেটের গায়ে চেপে বসার চেষ্টা করছে।

দক্ষিণ এশিয় প্লেট যেভাবে তরী ভিড়ালো।


মূল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলি লাল দাগের ভেতর।

















একটা প্লেট আরেকটা প্লেটের গায়ে চেপে বসলে তাদের মাঝে যে গ্যাপটা আছে, সেখানে অবস্থানরত ভূগর্ভস্থ গ্যাসগুলো বের হয়ে আসে। আবার ঘুরিয়ে চিন্তা করলে ভূগর্ভস্থ গ্যাস এর চাপ বের হয়ে আসলে ওই শূণ্যস্থান পূরণের জন্য ভূমি সরে যায়। তখন আমরা ভূমিকম্প অনুভব করি।

তো আমাদের কনটেক্সটে লাল চিহ্নিত অংশুটুকুতেই বেশিরভাগ বড় বড় ভুমিকম্পগুলো হয়েছে। এগুলো দৈব নয়, ঐগুলিতেই হওয়ার কথা। এবং সেগুলির একটা প্যাটার্নও খুজে পাওয়া সম্ভব। আফগানিস্তানের বর্ডার, নেপাল, মিয়ানমার ইত্যাদি জায়গার ভূমি নিজের মত সরে সরে গিয়েছে। একটা জায়গায় গ্যাপ থেকে গেছে সেটা হলো সিলেটের খুব কাছে ডাউকি ফাটলে। এই ফাটলকে ইন্টারসেক্ট করেছে শিলং প্লেটো, এই কারণে ডাউইকির একটু বিশেষ তাৎপর্য আছে। সেখানে শখানেক বছর আগে শেষ ভূগর্ভস্থ চাপ অবমুক্ত হয় (যার কারণে ১৮৯৭-এ ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথই পালটে যায়)। এর পর অন্য ফাটল বা গ্যাপ গুলি থেকে চাপ নির্গমন ('১৫র নেপাল, গেল বছর মিয়ানমার) হয়ে গেছে, কিন্তু ডাউকি থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া যায় নি। এ্যামেরিকান জিওলজিস্টরা বলছেন, ডাউইকি ফাটল জীবন্ত হয়ে ওঠার সময় পার হয়েছে অনেক আগেই। যত দেরি হবে তার তীব্রতা (পড়ুন ভয়াবহতা)-ও তত বেশি হবে। এখন, কবে হবে সেটা বোঝার একটা উপায় হলো বড় ভূমিকম্পের আগে দিয়ে মূল ফাটলের আশে পাশের শাখা ফাটলে ছোট ছোট কম্পন হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে গতকাল (৩ জানুয়ারি ২০১৭)-এর কম্পন দুটোই ডাউকির কাছে ত্রিপুরা এবং আরাকান হতে উৎপন্ন। সুতরাং দু'শো বছরের অপেক্ষার পালা প্রায় শেষ যে কোন মুহূর্তে (এই লেখার শেষে একটা নিউজ লিঙ্ক আছে)। উল্লেখ্য, ২০১৫তে নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের আগে খুব ছোট মাত্রার বেশ কয়েকটা কম্পন ধরা পড়েছিলো। [ডাউকি ফল্টের জিওলজিক্যাল ইতিহাস এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে কয়েকটা ভালো এবং বড় গবেষণা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই করেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ সেগুলির কথা জানতে পারছে না।]






ডাউকি এবং শিলং ফল্টের অবস্থান।


বড় ভূমিকম্প বকেয়া আছে, হলে কী কী হবে, কত জন আনুমানিক মারা যাবে, ক্ষয় ক্ষতি কেমন হবে, এইসব ইতিহাস আমাদের প্রায় মুখস্ত। কেউ এগুলি নিয়ে প্যাচাতে আসলে বিরক্ত লাগে। কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। হেসে উড়াবো না তো মুখ গোমড়া করে বসে থাকবো? না। যা ক্ষতি হবে সেগুলো ঠেকানোর উপায় মানবসন্তানের জানা নেই, সেই ক্ষমতাও নেই। কিন্তু মানুষ সতর্ক থাকতে পারে। নলেজ শেয়ার করতে পারে। প্রি-কশন নিতে পারে।

ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান এ্যান্ড্রিয়াস ফল্টে একটা বিভৎস ভূমিকম্প অনেক বছর ধরে বকেয়া। তারা কিন্তু জিনিসটাকে গা সওয়া বানিয়ে ফেলেননি। প্রত্যেক মাসে জিওলজিস্টরা সার্ভে করছেন, ইঙ্গিত গুলো বুঝার চেষ্টা করছেন, জাতীয় পর্যায়ে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাচানোর জন্য, সেই নিয়ে গবেষণা করছেন। আমার আক্ষেপ হলো, এই বকেয়া ভূমিকম্প নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নাই। আমাদের এখানে যা গবেষণা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ সেগুলি না জানলে মানসিক প্রস্তুতি নেবে কীভাবে? "যখন মৃত্যু আসবে তখন দাঁত কেলিয়ে মরে যাবো" তো কোন কাজের কথা না? মানুষের জীবনের দাম এতই কম?

আতংক নয়, ফ্যাক্ট, ডাউকি এ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেল কয়েকবারের মত 'মৃদু ঝাঁকুনি অনুভূত' হবে না, আমাদের সভ্যতাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তার আগেই মানুষের প্রাণ বাচানোর কোন একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। ঢাকার উপর অবিলম্বে জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসনিক পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেকটা সচেতন নাগরিকের জানতে হবে এই ভূমিকম্প কীভাবে হতে যাচ্ছে, কীভাবে এর থেকে বাচা যায়, কীভাবে আরেকটু সতর্ক থাকা যায়। দুশ্চিন্তায় জীবন থামিয়ে দেবার কথা বলছি না, বলছি খাওয়া-ঘুমের মতই সতর্কতাটুকু গ্রহণ করার কথা।

সকলের জন্য সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের কামনা করছি।


নিউজ লিঙ্কঃ http://www.dailymail.co.uk/…/Giant-megathrust-fault-discove…

গবেষণা লিঙ্কঃ
১। http://www.sciencedirect.com/…/article/pii/S1367912011002021
২। http://www.sciencedirect.com/…/article/pii/S1367912014002454

বিঃদ্রঃ https://www.usgs.gov এ ভিজিট করে পৃথবীতে ঘটা বর্তমান এবং বিগত সব ক'টা ভূমিকম্পের ভিজ্যুয়াল পাওয়া সম্ভব। বেকার বসে থাকলেই আমি মুখ আমশি করে এই সাইট খুলে দেখতে থাকি।