শিক্ষা নিয়ে
লেখা। তাই মনে হলো ওজনদার কিছু থিওরি কপচানো গেলে বেশ লাগবে। এই ভেবে পরীক্ষা, অভীক্ষা, মূল্যায়ন ইত্যাদি নিয়ে রবার্ট লিন নামের এক
অ্যামেরিকান ভদ্রলোকের লেখা একখানা বই পড়ছিলাম। পড়ার মধ্যেই মনে মনে অন্বেষণ ছিলো
আমাদের ঢাবি’র ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত কিছু পাওয়া যায় কিনা। তো যা পেলাম, মূল
আলোচনায় চলে যাওয়ার আগেই বলে না নিলে জমছে না!
বইতে
লেখা যে, যে কোন পরীক্ষা নেওয়ার আগে সম্পূর্ণ পরীক্ষার যথার্থতা, নির্ভরযোগ্যতা
এবং ব্যাবহারযোগ্যতা যাচাই করে নিতে হবে এবং এই কয়টা বিষয়ে নিশ্চিত ধারণা রাখতে
হবে। পরের লাইনেই লেখা, “পাঠকের মনে উদয় হতে পারে এই তালিকায় ‘সততা’ কেন
অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন না করাটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়। কিন্তু আমরা আলাদা করে এটা
অন্তর্ভুক্ত করি নি কারণ ব্যাপক অর্থে সততা নিশ্চিত করা পরীক্ষার
যথার্থতারই একটা অংশ!”
যাকগে।
অনেকদিনের জমানো চিন্তা এবং খানিকটা ক্ষোভ থেকেই এই লেখাটার জন্ম। ক্ষোভের উদ্ভব
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রারম্ভেই। এক শিক্ষকের মুখেই আক্ষেপটা শোনা, বহু ভর্তিচ্ছু
পরীক্ষার্থী প্রশ্নপত্র পাওয়ার আগেই নাকি সেট কোড পূরণ করে ফেলে! অনেকেরই পরীক্ষা
আধা ঘন্টার মাঝেই শেষ হয়ে যায়। সংবাদ-মাধ্যমের চোখ এড়িয়ে যায়, কিন্তু বিভোর
শিক্ষার্থীদের ভাঙ্গা স্বপ্ন জোড়া লাগে না! ভর্তি পরীক্ষায় অসততা আরও কী কী উপায়
এবং পদ্ধতিতে ঘটা সম্ভব সে বিষয়ে পাঠকের পরিষ্কার ধারণা না থাকাটাই অস্বাভাবিক। আমরা
অন্ধকার আলোচনা না করে এই বেলা বরং কিছুটা আলোর সন্ধান করে ফেলি।
ধরুন
দেশের বাইরে আপনি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে চান, উদ্দেশ্য স্নাতকোত্তর পাঠ।
উচ্চশিক্ষায় বর্তমান যুগের প্রথম পছন্দ যুক্তরাষ্ট্র। কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়
পছন্দ করার পর আপনি সবার আগে দেখবেন তারা জি আর ই স্কোর কত চায়। ১৯৪৭ সালে গঠিত
এজুকেশনাল ট্রেইনিং সার্ভিস (ইটিএস) পরিচালিত এই পরীক্ষা দ্বারা কেবল যুক্তরাষ্ট্র
নয়, সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের যাচাই করে ফেলা যায়। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয়
হলো, স্নাতকে আপনি যা পড়ছেন, সে বিষয়ে কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা ছাড়াই তারা বলে দিতে
পারবে আপনার মানস ঐ বিষোয়ে স্নাতকোত্তর করার যোগ্য কিনা! শুধু তাই নয়, আপনার ঝোঁক
কোন দিকে, আপনি কেমন মানসিকতার লোক, তাও আপনার টেস্ট স্কোর যাচাই করে বলে দিতে
পারেন অ্যামেরিকান প্রফেসররা। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র সারা পৃথিবী থেকে যত ‘ক্রিম অফ
দি সার্ফেস’ শিক্ষার্থী আছে, তাদের কিনে নিচ্ছে। সেসব শিক্ষার্থীরা এত সুযোগ
সুবিধা হয়তো কখনই নিজেদের দেশে পেতেন না, তাই দিন শেষে কেবল এক যাচাই করার পরীক্ষা
আবিষ্কার এবং প্রবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশ গুলি বিজয়ের হাসি হাসছে।
বলা
হয়, শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে নাকি সমগ্র দেশ ভেঙ্গে পড়বে। আমি অবাক হয়ে ভাবি
আমরা এখনও কিসের উপর দাঁড়িয়ে আছি! সমস্যা তো কম নয়। সারা পৃথিবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়ার জন্য কী যোগ্যতা এবং ক্ষমতা দরকার তার উপর ভিত্তি করে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং
উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা বেড়ে উঠে। আর আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীরা দু’কুলের কোন সেতুবন্ধনই খুঁজে পায় না। উন্নয়নশীল
দেশ বলে এনজিও-আইএনজিওরা প্রাথমিক শিক্ষা গঠনের জন্য কোটি ডলারের ব্যবসা করে যায়,
কিন্তু সরকার-জনগণ কারো খেয়াল নাই যে বিশ্ববিদ্যালয় কোন বিচ্ছিন্ন জায়গা নয়, এবং
এখান থেকেই সিদ্ধান্ত নিম্নগামী হওয়া বাঞ্ছনীয়। তার পরও দেশ চলছে, কিছু থেমে নেই।
বলছিলাম
ভর্তি পরীক্ষার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫টা ইউনিট এবং ১৩টা ইন্সটিটিউটে ২০১৩
সালের ভর্তি পরীক্ষায় সর্বমোট অংশগ্রহণ করেছে মোটা দাগে ৩ লক্ষ শিক্ষার্থী, যেখানে
আসন ৫ হাজার ৫০০ মত! পরীক্ষার দিন খবরের কাগজে দেখা যায় ‘আজ ঢাবিতে ভর্তি যুদ্ধ’।
সীমিত আসন, ইচ্ছা থাকলেও সবাইকে পড়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না এটাই স্বাভাবিক। ‘ভর্তি’
পরীক্ষা না বলে ‘ছাঁটাই’ পরীক্ষা বলাই ভালো। কিন্তু তার পরও যারা এই পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে তাদেরও নিশ্চই ‘ক্রিম অফ দি সার্ফেস’ হওয়ার কথা।
ভয়ের কথা হচ্ছে, ভর্তিচ্ছু সব শিক্ষার্থী ক্রিম নয়, বরং ক্রিমিনাল বলা চলে! (সমস্যা
হলো, যেই ছেলেটাকে এই মাত্র ক্রিমিনাল বললাম, সে আমার ভাইও হতে পারে! হয়তো
উচ্চশিক্ষায় সে আর কয়েক বছর পর ভাল একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেও চলে যাবে!) ক্ষুদে
বার্তায় উত্তর বাৎলে দেওয়া পুরাতন খবর হলেও এই বছরের ক-ইউনিটের পরীক্ষায় ১৪ জন ধরা
পড়েছে, কত জন ধরা পড়েনি সেটাই চিন্তার বিষয়। এক পরীক্ষার্থী ক্যালকুলেটরের ভিতর
মুঠোফোন সেট করে পরীক্ষা দিতে এসেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস তো ডালভাত বিষয় হয়ে গেছে! দেশের
জন্য ভয়ের বিষয় হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে দেশের মানুষের ঘাম ঝরানো টাকায়।
সেই টাকায় সন্ত্রাসী-বাটপার পড়ানোর ক্ষমতা আমাদের স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর এখনও হয়ে
উঠেনি। এতটা উদার হওয়ার অবস্থা বাংলাদেশের আসলেই তৈরী হয়নি।
একটা
অনুকরণীয় উদাহরণ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে ২০০৬
সালের পরীক্ষায় (সম্ভবত) অংশগ্রহণ করেছিল ১৫০০০ এর কিছু বেশি শিক্ষার্থী, কিন্তু
১২০টা আসন থাকার পরও ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো মাত্র ২০ জন। সৎ বা অসৎ কোন ভাবেই
অযোগ্য শিক্ষার্থীদের পড়ানোর ব্যয় এই ইনস্টিটিউট বহন করে না। তাহলে সমগ্র
বিশ্ববিদ্যালয় কেন এই দায় নিজের ঘাড়ে নেয়?
প্রশাসনের
মাঝে ফাঁক সারা পৃথিবীতেই আছে। আমরা বলছিনা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চেষ্ট। আমরা বলছি, যে পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়ায় ফাঁক
রয়েছে তা পরিষ্কার, সেখানে উন্নত ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হচ্ছে না? যুক্তরাষ্ট্র
কেন জিআরই প্রণয়ন করে জগৎ ছেঁকে সব ভালো মাথাগুলিকে নিয়ে যাবে আর আমাদের
পত্র-পত্রিকায় খবর উঠবে “ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতিঃ আটক ২”। আমরা কি
এতই হীন? আমাদের ছেলেমেয়েরা কি মানসিক ভাবে এতই অসহায়, যে সামান্য ভর্তি পরীক্ষাও
নিজের যোগ্যতায় বসতে ভয় পায়?
গেলো
সমস্যার কথা। সমাধান কী হতে পারে? শিক্ষা নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাঁরা একটা ধারণা
ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। একে বলা হয় Standardized Test বা প্রমিত পরীক্ষা।
সোজা বাংলায় যে পরীক্ষার উপর শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক-দেশের মানুষ-প্রশাসন সকলেই
পরম নির্ভরতায় বিশ্বাস রাখতে পারে যে এই পরীক্ষায় যাদের পাশ করার কথা তারাই পাশ
করবে।
দেশের
মাথাগুলি সব এক হয়ে একমুখী সৃজনশীল শিক্ষা ব্যাবস্থা, কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা
নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু আমরা কি এতটুকু আশা করতে পারি যে তাঁরা দয়া করে ভর্তি
পরীক্ষার প্রশ্নের আইটেম এবং ধরণের উপরও একটুখানি সুনজর দেবেন? উচ্চমাধ্যমিকের
হিসাব বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো ব্যাবসায় প্রশাসনে কোন কাজে আসে না, তবে সেই
বিষয় থেকে কেন প্রশ্ন করা হবে? যদি গানিতিক বুদ্ধিমত্তাই যাচাই করতে হয়, তবে ক, খ,
গ এবং ঘ ইউনিটে সোজাসুজি তাই করা হয় না কেন?
ভাষা
প্রয়োজন যোগাযোগের জন্য। জিআরই বা আইবিএ যেখানেই বলুন না কেন, ভাষার দক্ষতা
যাচাইয়ের জন্য সোজাসুজি ভাষার দক্ষতাই যাচাই করে ফেলা হয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
পড়ে শিক্ষার্থী মহাজ্ঞানী হয়ে গেছে কিনা তা যাচাই করা হয় না।
সারা
দেশে পছন্দের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শিক্ষার্থী-অভিভাবক মহলে সমরযাত্রার
থেকেও ভয়াবহ। কি তার প্রস্তুতি, কত তার আচার! ঢাকায় সকালে ঢাবি’র পরীক্ষা দিয়েই
মুখে একটা সিঙ্গাড়া গুঁজে নিয়ে দুপুরে জগন্নাথে ছুটো! পরের দিনই আবার রাজশাহীতে
ছুট ছুট। তার দু’দিন পরই আবার খুলনা! শুধু তাই? বিজ্ঞান, কলা বা ব্যাবসায় অনুষদে পরীক্ষা দিয়ে ফল প্রকাশের আগেই আবার বিভাগ
পরিবর্তনের পরীক্ষা।
কেবল
এক খানা পরীক্ষা নিয়ে বাচ্চাগুলিকে ছেড়ে দেওয়া যায় না? যাচাই করাই তো কাজ। প্রশ্ন
তো এমনও করা সম্ভব, ফাঁস হোক বা না হোক, শিক্ষার্থীকে নিজের যোগ্যতায়ই হলে বসে
তাঁর সমাধান করতে হবে। অপর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবক মহলেও কেবল
একটা পরীক্ষায় বসারই চিন্তা মাথায় থাকবে। সম্মানিত শিক্ষকরাও উত্তরের ধরণ দেখেই
বলে দিতে পারবেন শিক্ষার্থীর ধাঁচ কেমন, কিসে তাঁর আগ্রহ এবং সে বিশ্ববিদ্যালয়ে
আবেদনকৃত বিষয় বা বিষয়গুলিতে পড়ার জন্য যোগ্য কিনা।
নৈরাশ্য বড় নেতিবাচক বস্তু, আমরা বরং আশায় বুক
বাঁধি। আমাদের পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রমিত পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে,
এই স্বপ্নে বুঁদ হয়ে কথা শেষ করছি।
তথ্যসূত্রঃ
৪। M.
David Miller, R. L. (2009). Measurement and Assessment in Teaching. New
Jersey: Pearson.
৫। শিখায় পরিমাপ ও
মূল্যায়ন। -প্রফেসর ড. শাহজাহান তপন
৬। শিক্ষাবিজ্ঞান ও
বাংলাদেশে শিক্ষা- আব্দুল মালেক, মরিয়ম বেগম।
[১ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের "প্রমিথিউস" নামক পুস্তিকার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংহতি দিবস সংখ্যায় প্রকাশিত]